গ্রামের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার যাঁরা নিরলস কাজ করেন তাঁরা ‘গ্রাম পুলিশ’ নামে পরিচিত। শহরের আলোয় তারা সহজে চোখে পড়েন না, কিন্তু গ্রামের প্রতিটা ঘাট, রাস্তা, গলি — প্রায় তারাই হয়ে থাকেন অদৃশ্য নিবেদিত প্রাণ।
কিন্তু যারা রাত জেগে পাহারা দেন, যারা অচেনা অন্ধকারে বাড়ি সুরক্ষিত রাখেন — তাদের নিজের জীবন ও শ্রমের মূল্যায়ন কি আদৌ থাকে? ছোট ছোট ভাতারও ঘোর অভাব — এ কথা অনেক দিন ধরেই আলোচনার বিষয়। বাংলার গ্রাম পুলিশের বেতন, মর্যাদা, স্বীকৃতি নিয়ে আজও ঘোর সঙ্কট।
এই প্রতিবেদনে আমরা বর্তমান বেতন কাঠামো, সাম্প্রতিক বৃদ্ধির খবর, জাতীয়করণ আন্দোলন এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা তুলে ধরব — সম্পূর্ণ নতুন শব্দ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে।
গ্রাম পুলিশ ইতিহাস ও গঠন
বাংলাদেশের প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদে বর্তমানে ১০ জন গ্রাম পুলিশ নিয়োজিত থাকেন — যার মধ্যে ১ জন দফাদার এবং ৯ জন মহল্লাদার।
এই গঠন প্রায় ৪,৫৭৬টি ইউনিয়নে অনুসরণ করা হয়।
এককভাবে ধরলে, গ্রাম পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার ৫০০ জনের মতো।
দায়িত্ব ও কাজের পরিধি
গ্রাম পুলিশদের কাজ শুধু পাহারা দেওয়া বা অপরাধ রোধ নয়। বর্তমান সময়ে তাদের দায়িত্ব বেড়েছে — যেমন:
- গ্রাম আদালতের নোটিশ ও জনসাধারণ তথ্য কার্যক্রম
- জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, জমির জরিপ, স্যানিটেশন সচেতনতা
- নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, যৌতুকবিরোধী প্রচার, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ
- গ্রামীন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সংঘাত নিষ্পত্তি
- প্রশাসনিক সহায়তা ও স্থানীয় কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা
এই ব্যাপক কাজের পরিধি অনেক সময় তাদের দায়িত্বের সীমার থেকেও বাড়ে, কিন্তু সুবিধা অনেকটা পিছিয়ে থাকে।
বর্তমান বেতন-ভাতা সীমাবদ্ধতার
বর্তমানে, গ্রাম পুলিশের দুঃখজনক বাস্তবতা হলো — কোন নির্দিষ্ট সরকারি বেতন স্কেল (জাতীয় বেতন-স্কেল) নেই।
সূত্রের ধারায়, একজন দফাদার প্রাপ্ত বেতন ৭,০০০ টাকা এবং একজন মহল্লাদার ৬,৫০০ টাকা প্রতি মাসে
এই বেতনকে আজকাল “বেসিক + ভাতা” মিলিয়ে দেওয়া হয়।
সাম্প্রতিক বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা (২০২৫)
২০২৫ সালের ২২ জুলাই, সরকার একটি বেতন ও অবসরকালীন (মৃত্যুকালীন) ভাতা বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী:
- দফাদারদের বেতন ও ভাতাসহ ৭,০০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৮,০০০ টাকা করা হবে।
- মহল্লাদারদের ৬,৫০০ টাকা থেকে ৭,৫০০ টাকা করা হবে।
তাছাড়া, তাঁদের আনুতোষিক (অবসর বা মৃত্যুকালীন) ভাতা দফাদারদের জন্য ৬০,০০০ থেকে ৮০,০০০, মহল্লাদারদের জন্য ৫০,০০০ থেকে ৭০,০০০ টাকা করা হবে।
এই বৃদ্ধির ঘোষণা গ্রাম পুলিশের মধ্যেই এক আগ্রাসী সাড়া সৃষ্টি করেছে — যদিও বাস্তব প্রয়োগ ও অর্থায়ন এখনও স্পষ্ট নয়।
সামাজিক ও মনগত প্রভাব
বেতন বৈষম্য শুধু আর্থিক সমস্যা নয় — সামাজিক মর্যাদা ও আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন করার উপাদান। গ্রাম তথা স্থানীয় মানুষের কাছে, গ্রাম পুলিশকে “সরকারি” বা “নিরাপত্তাদায়ী” হিসেবে ভাবা হয়, কিন্তু মানুষ দেখেন শুধু তাদের দুর্বল ভিত্তি।
এটি মর্যাদাহীনতা, আস্থা কমে যাওয়া, প্রেরণাহীনতা — এমন অনেক নেতিবাচক দিক জন্ম দেয়।
আন্দোলন ও দাবির খোঁজে
গ্রাম পুলিশরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের অধিকার আদায়ের দিকে এগিয়ে এসেছেন — অবহেলা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তারা বিভিন্ন সময়ে রণক্ষেত্রে নেমেছেন।
- ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট থেকে “বেতন বৈষম্যবিরোধী গ্রাম পুলিশ সমন্বয় কমিটি” তাঁদের চাহিদি নিয়ে প্রতিবাদ শুরু করে।
- তারা গ্রাম পুলিশের জাতীয়করণ (সরকারি কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতি) দাবি করে আন্দোলন গড়ে তোলে।
দফা দাবি ও সংগ্রাম
গ্রাম পুলিশের মূল দাবিগুলো হলো:
- চাকরি জাতীয়করণ — ৪৭ হাজারের বেশি গ্রাম পুলিশের সদস্যদের সরাসরি সরকারি কর্মচারীতে পরিণত করা।
- জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্তি — দফাদারদের জন্য ১৯তম গ্রেড, মহল্লাদারদের জন্য ২০তম গ্রেড।
- বেতন-ভাতা ও অবসর সুবিধা — উপযুক্ত বৃদ্ধি ও নিয়মিত অর্থায়ন।
- প্রশিক্ষণ ও কাজের স্বীকৃতি — পেশাদার সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ ও মর্যাদা।
বিচারপথে মামলা ও আইনগত দ্বন্দ্ব
- ২০১৭ সালে প্রায় ৩৫৫ জন গ্রাম পুলিশ রিট করেন, যাতে তাদের ২০১১ সালের গেজেটে প্রতিষ্ঠিত বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানানো হয়।
- ২০১৯ সালের ১৫–১৭ ডিসেম্বর, হাইকোর্ট রায় দেয় — দফাদারদের ১৯তম গ্রেড, মহল্লাদারদের ২০তম গ্রেডে বেতন-মঞ্জুরি প্রদান করার নির্দেশ।
- কিন্তু আপিল বিভাগ সেই রায় সর্বশেষে স্থগিত করে।
এই বিচারিক লড়াই এখনও চলছে — ফলে চার বছরেরও বেশি সময় বুঝে ওঠা যাচ্ছে না, এক আদর্শ সিদ্ধান্ত আসবে কি না।
কি পরিবর্তন হবে ২০২৫-২৬
নিচে সম্ভাব্য পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জের কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো:
- বেতন বৃদ্ধি প্রয়োগ
২০২৫ সালে বেতন বৃদ্ধি প্রজ্ঞাপন কার্যকর করার জন্য সরকারি নীতি নেওয়া হয়েছে।
দফাদারদের জন্য ৮,০০০ টাকা এবং মহল্লাদারদের জন্য ৭,৫০০ টাকার সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছে। - অবসরকালীন ভাতার প্রসার
দফাদারদের অবসরকালীন ভাতা ৮০,০০০ এবং মহল্লাদারদের ৭০,০০০ টাকায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। - জাতীয়করণের সম্ভাবনা
আন্দোলন ও রাজনৈতিক চাপের ফলে জাতীয়করণ নিয়ে নতুন আলোচনাও চলছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের পর্যায়ে “গ্রাম পুলিশ নতুন বেতন বৃদ্ধির সুখবর” শিরোনামে ইতিমধ্যেই কিছু ঘোষণাও প্রকাশ পেয়েছে। - সামাজিক স্বীকৃতি বৃদ্ধি
বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি, গ্রাম পুলিশদের কর্মের গুরুত্ব ও মর্যাদা ক্রমে জনসাধারণ ও প্রশাসন উভয়দিকেই ধরা পড়ছে।
শেষ কথা
গ্রাম পুলিশ আমাদের গ্রামীণ জীবনের শান্তির অদৃশ্য রক্ষাকর্তা। তাদের কাজ কখনও আলোচনা পায় না, তাদের জীবনের সংগ্রাম প্রায় অজানা থেকেই যায়।
বর্তমান সময়ে, তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, গেজেট প্রকাশ ও জাতীয়করণের দাবির সাথে–সাথে সামাজিক ও নৈতিক দাবি ঝরে পড়েছে। ২০২৫ সালে বেতন বৃদ্ধি ঘোষণা একটি ইতিবাচক ধাপ, কিন্তু সেটা নিশ্চিতভাবে কার্যকর হলে সত্যিকার পরিবর্তন হবে।
ভবিষ্যতে, একটি সুসংগঠিত কাঠামো, ন্যায্য মান্যতা, স্বচ্ছায়নের ব্যবস্থা এবং এক অক্লান্ত সংগ্রামে গড়ে ওঠা বিশ্বাস — এ সব মিলিয়ে গ্রাম পুলিশকে শুধু “গ্রামের রক্ষক” নয় এক মর্যাদাবান সরকারি কর্মচারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে।