ক্রোয়েশিয়া, ইউরোপ মহাদেশের একটি সেনজেন ভুক্ত দেশ, যেখানে প্রতিবছর হাজার হাজার শ্রমিক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে পাড়ি জমায়। এই দেশটি তার সৌন্দর্য ও উন্নত মানের জীবনের জন্য যেমন পরিচিত, তেমনই রয়েছে বিভিন্ন খাতে কর্মসংস্থানের প্রচুর সুযোগ। তবে, ক্রোয়েশিয়ায় কাজের উদ্দেশ্যে যাওয়ার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেওয়া প্রয়োজন, যেমন কোন কাজে চাহিদা বেশি, কত খরচ লাগবে, ভিসা আবেদনের প্রক্রিয়া এবং বেতন কাঠামো। এই গাইডটি আপনাকে ক্রোয়েশিয়ায় কাজের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেবে এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
ক্রোয়েশিয়ায় কর্মসংস্থানের কোন কাজগুলোর চাহিদা বেশি
ক্রোয়েশিয়াতে বিভিন্ন সেক্টরে কর্মসংস্থানের চাহিদা রয়েছে। তবে কিছু নির্দিষ্ট কাজের জন্য শ্রমিকের প্রয়োজন অনেক বেশি। এসব কাজের জন্য দক্ষ শ্রমিকদের বেশি সুযোগ এবং তুলনামূলক ভালো বেতন দেওয়া হয়। নিচে ক্রোয়েশিয়াতে বেশি চাহিদাসম্পন্ন কাজগুলো উল্লেখ করা হলো:
১. ইলেকট্রিশিয়ান
ইলেকট্রিশিয়ানের প্রয়োজনীয়তা ক্রোয়েশিয়ায় প্রতিনিয়তই রয়েছে। বিদ্যুৎ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পে অভিজ্ঞ ইলেকট্রিশিয়ানদের উচ্চ বেতনে নিয়োগ দেওয়া হয়।
২. মেকানিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং
মেশিন মেরামত এবং বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে মেকানিক্যাল কর্মীদের চাহিদা বেশ রয়েছে। ক্রোয়েশিয়ার উন্নয়নশীল শিল্পের জন্য অভিজ্ঞ মেকানিক এবং ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে।
৩. হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট জব
ক্রোয়েশিয়া একটি পর্যটনপ্রধান দেশ হওয়ায় হোটেল এবং রেস্টুরেন্টে কর্মসংস্থানের সুযোগ ব্যাপক। কুক, ওয়েটার, হাউসকিপার এবং রিসেপশনিস্টের মতো পদগুলোতে বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
৪. ড্রাইভিং
গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা থাকলে ক্রোয়েশিয়ায় ড্রাইভার হিসেবে কাজ করার সুযোগ আছে। বিশেষত ট্রাক ড্রাইভারদের চাহিদা রয়েছে।
৫. ফুড ডেলিভারি ম্যান
অনলাইন ফুড ডেলিভারি সেবার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণে ফুড ডেলিভারি কর্মীদের জন্য নিয়োগের চাহিদা বাড়ছে।
৬. কনস্ট্রাকশন শ্রমিক
বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পে শ্রমিকের চাহিদা ব্যাপক। নির্মাণ কর্মীদের কাজের সুযোগ এবং বেতন উভয়ই ভালো।
৭. শপিং মলে বিক্রয় কর্মী
শপিং মল এবং বিভিন্ন খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানে বিক্রয় কর্মী প্রয়োজন হয়। বিক্রয় দক্ষতা থাকলে এই কাজের জন্য ভালো সুযোগ পাওয়া যায়।
৮. ক্লিনার
হোটেল, অফিস এবং বাড়িতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য ক্লিনারদের চাহিদা রয়েছে।
৯. কৃষিকাজ
কৃষি খাতে বিভিন্ন ধরনের কাজের চাহিদা থাকে। ক্রোয়েশিয়ায় বিশেষত ফল সংগ্রহ এবং প্যাকেজিংয়ের কাজে শ্রমিক নিয়োগ হয়।
এছাড়া ফুট প্যাকেজিং, গবাদি পশু পালন, এবং টাইলস ফিটিং কাজেও চাহিদা রয়েছে। এসব কাজের ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করে ভিসা আবেদন করলে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
ক্রোয়েশিয়া যেতে খরচ কত লাগে
ক্রোয়েশিয়াতে কাজের জন্য যেতে হলে বেশ কিছু খরচ হতে পারে। ভিসা প্রক্রিয়া এবং বিমানের খরচ এক্ষেত্রে প্রধান। খরচের মধ্যে প্রধানত কাজের ভিসা ফি, বিমানের টিকিট এবং অন্যান্য প্রসেসিং খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকে।
কাজের ভিসা খরচ
ক্রোয়েশিয়ার কাজের ভিসার খরচ তুলনামূলক বেশি। কাজের ভিসা বা ওয়ার্ক পারমিট পেতে সাধারণত ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ হয়। এজেন্সি বা দালালের মাধ্যমে প্রক্রিয়া করলে এই খরচ আরো ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।
স্টুডেন্ট ভিসা খরচ
ক্রোয়েশিয়ায় শিক্ষার জন্য যেতে চাইলে স্টুডেন্ট ভিসার খরচ প্রায় ৫-৬ লাখ টাকা হয়। তবে, যদি স্কলারশিপ পাওয়া যায়, তাহলে খরচ অনেকটাই কমে আসবে।
অতিরিক্ত খরচের মধ্যে বিমানের টিকিট এবং বসবাসের প্রাথমিক খরচ রয়েছে।
ক্রোয়েশিয়া যেতে কি কি কাগজপত্র লাগে
ভিসার জন্য আবেদন করতে হলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হবে। ভিসা আবেদন ফরম পূরণ করার পাশাপাশি নিম্নলিখিত কাগজপত্র প্রস্তুত রাখতে হবে:
- ভিসা আবেদন ফরম: ক্রোয়েশিয়ার ভিসা সেন্টার বা অনলাইনে আবেদন ফরম পূরণ করতে হবে।
- পাসপোর্ট: ৬ মাস মেয়াদি বৈধ পাসপোর্ট থাকা আবশ্যক।
- ছবি: সদ্য তোলা পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি।
- জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম সনদ: জাতীয় পরিচয়পত্র বা অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদ।
- মেডিকেল রিপোর্ট: শারীরিক সুস্থতার প্রমাণস্বরূপ মেডিকেল রিপোর্ট।
- পুলিশ ক্লিয়ারেন্স: অপরাধমুক্ত থাকার প্রমাণ হিসেবে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট।
- করোনা টিকা সনদ: বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের টিকা সনদ থাকা বাধ্যতামূলক।
- ব্যাংক স্টেটমেন্ট: আবেদনকারীর বিগত ৬ মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট।
- কাজের অফার লেটার: ক্রোয়েশিয়ার নিয়োগকর্তার কাছ থেকে অফার লেটার।
এই কাগজপত্র সঠিকভাবে প্রস্তুত এবং জমা দিলে ভিসা প্রসেসিং সহজ হয় এবং অনুমোদনের সম্ভাবনা বাড়ে।
ক্রোয়েশিয়া ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া ২০২৪
বর্তমান যুগে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে ঘরে বসেই ক্রোয়েশিয়া ভিসার জন্য আবেদন করা যায়। অনলাইনে আবেদন করার ধাপগুলো নিম্নরূপ:
- প্রথমে ক্রোয়েশিয়া ভিসা আবেদন ওয়েবসাইট-এ প্রবেশ করুন।
- ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন ফরম পূরণ করুন এবং প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করুন।
- সকল তথ্য দেওয়ার পর ফরমটি সাবমিট করুন।
- আবেদন জমা দেওয়ার পর ভিসা প্রসেসিংয়ের সময়সীমা শেষ হলে ইমেইলে আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
অতিরিক্তভাবে, যেহেতু বাংলাদেশে ক্রোয়েশিয়া দূতাবাস নেই, তাই ভিসা আবেদনকারীদের ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত ক্রোয়েশিয়া দূতাবাসে যেতে হতে পারে।
ক্রোয়েশিয়া শ্রমিকদের বেতন কাঠামো ২০২৪
ক্রোয়েশিয়াতে শ্রমিকদের বেতন মূলত কাজের ধরনের উপর নির্ভর করে। নতুন শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বেতন প্রায় ৯০ হাজার টাকা এবং অভিজ্ঞ শ্রমিকদের বেতন প্রায় ১ লাখ টাকা। যারা ওভারটাইম করেন, তারা মাসে ১,২০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন।
ক্রোয়েশিয়াতে কাজের জন্য বয়সসীমা
ক্রোয়েশিয়ায় কাজের ভিসার জন্য আবেদনকারীর বয়স ন্যূনতম ২১ এবং সর্বোচ্চ ৪৫ বছর হতে হবে। তবে টুরিস্ট বা ভিজিট ভিসার ক্ষেত্রে বয়সের কোন সীমাবদ্ধতা নেই।
ক্রোয়েশিয়া ভিসা পেতে কত সময় লাগে
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ক্রোয়েশিয়ার ভিসা পেতেও কিছুটা সময় লাগে। সাধারণত ভিসা প্রসেসিংয়ে ২ থেকে ৩ মাস সময় লাগে। তবে বাংলাদেশে ক্রোয়েশিয়া দূতাবাস না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে ৬ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এজন্য অনেককেই ভারতের দিল্লিতে গিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়।
শেষ কথা
বর্তমান সময়ে ক্রোয়েশিয়া ভিসার বিষয়ে অনেক ধরণের চটকদার বিজ্ঞাপন এবং প্রলোভনমূলক অফার দেখা যায়। এসব বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং, এ ধরনের প্রলোভনে পড়ে দালাল বা এজেন্সিকে বাড়তি টাকা না দিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ক্রোয়েশিয়া যেতে চাইলে বাংলাদেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় দিল্লিতে ক্রোয়েশিয়া দূতাবাসের মাধ্যমে ভিসা আবেদন করা শ্রেয়।