রেমিট্যান্স কাকে বলে? বাংলাদেশের রেমিট্যান্স খাত

রেমিট্যান্স, যাকে সহজ ভাষায় প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ বলা হয়, একটি দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায় না, বরং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং অবকাঠামো উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের জন্য রেমিট্যান্স একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচিত, যা জিডিপি বৃদ্ধিতে সরাসরি অবদান রাখে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ এবং অন্যান্য উৎস থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

WhatsApp Channel Join Now
Telegram Channel Join Now

এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো রেমিট্যান্সের সংজ্ঞা, বাংলাদেশের রেমিট্যান্স খাত, এর প্রভাব, এবং এই খাতকে আরও উন্নত করতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো।

পোষ্টের বিষয়বস্তু

রেমিট্যান্স কাকে বলে?

রেমিট্যান্স বলতে সাধারণত বোঝানো হয় প্রবাসে কর্মরত ব্যক্তিদের দ্বারা তাদের পরিবার বা প্রিয়জনদের কাছে পাঠানো অর্থ। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রার উৎস। তবে রেমিট্যান্সের ধারণা শুধুমাত্র প্রবাসী আয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি আরও বিস্তৃত অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:

  1. শিল্প ও পণ্য রপ্তানি থেকে আয়
    যেমন বাংলাদেশের পোশাক শিল্প, যা বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম বড় উৎস।
  2. বৈদেশিক বিনিয়োগ থেকে অর্জিত মুনাফা
    বিদেশি বিনিয়োগ বা অংশীদারিত্বের মাধ্যমে অর্জিত মুনাফাও রেমিট্যান্স হিসেবে বিবেচিত হয়।
  3. ফ্রিল্যান্স আয়
    লক্ষ লক্ষ ফ্রিল্যান্সার অনলাইনে কাজ করে বিভিন্ন দেশের ক্লায়েন্টদের থেকে ডলার উপার্জন করছে, যা রেমিট্যান্স প্রবাহকে শক্তিশালী করেছে।

বাংলাদেশের রেমিট্যান্স খাত মূলত প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের উপর নির্ভরশীল হলেও ফ্রিল্যান্সিং এবং প্রযুক্তি খাতও ক্রমবর্ধমান হারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশের রেমিট্যান্স খাত

বাংলাদেশ রেমিট্যান্স প্রাপ্তির দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ২১.৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

প্রবাসী-প্রেরিত আয়ের প্রধান উৎস

বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রধানত নিম্নোক্ত দেশগুলো থেকে আসে:

  • সৌদি আরব: রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে।
  • সংযুক্ত আরব আমিরাত
  • যুক্তরাষ্ট্র
  • মালয়েশিয়া
  • কুয়েত

বিভাগভিত্তিক রেমিট্যান্স প্রবাহ

ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিভাগ রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে প্রথম তিন অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চল থেকে প্রবাসে কর্মরত জনগণের সংখ্যা বেশি, যা এই অঞ্চলে রেমিট্যান্স প্রবাহকে বাড়িয়ে তোলে।

রেমিট্যান্সের প্রভাব অর্থনীতির

রেমিট্যান্স শুধুমাত্র বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি করে না, এটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও অনেক অবদান রাখে।

১. জিডিপি বৃদ্ধিতে অবদান

বাংলাদেশের জিডিপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে। এটি অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় সহায়ক।

২. দারিদ্র্য বিমোচন

রেমিট্যান্স গ্রামের মানুষের আয় বৃদ্ধি করে, যা দারিদ্র্য হ্রাসে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অনেক পরিবার প্রবাসী আয়ের উপর নির্ভরশীল এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।

৩. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি

রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়িয়ে তোলে, যা আমদানি খাতে ব্যয় মেটাতে এবং মুদ্রার স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়ক।

৪. বিনিয়োগ বৃদ্ধি

রেমিট্যান্সের অর্থ ব্যবহার করে অনেক মানুষ ব্যবসায় বিনিয়োগ করে। এভাবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।

৫. শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বৃদ্ধি

রেমিট্যান্স পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়ানোর সুযোগ দেয়। এতে সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।

৬. মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ

বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।

রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে সরকারের পদক্ষেপ

বাংলাদেশ সরকার রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং এটি আরও কার্যকরভাবে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। নিচে এসব উদ্যোগের বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:

১. রেমিট্যান্স প্রণোদনা

সরকার বর্তমানে ২.৫% রেমিট্যান্স প্রণোদনা প্রদান করছে, যা বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য প্রবাসীদের উৎসাহিত করে।

২. বৈধ চ্যানেল ব্যবহারে উৎসাহ

হুন্ডি বা অবৈধ পদ্ধতির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করতে সরকার নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রবাসীদের ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।

৩. রেমিট্যান্স খরচ কমানো

রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানোর লক্ষ্যে ব্যাংক ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসগুলোতে বিশেষ ছাড় দেওয়া হচ্ছে।

৪. দক্ষ জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধি

সরকার দক্ষ জনশক্তি প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, এবং নির্মাণ খাতে দক্ষ কর্মী তৈরির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

৫. প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা

প্রবাসীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এবং তাদের সাথে সরকারের যোগাযোগ বাড়াতে প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা গঠন করা হয়েছে।

৬. হুন্ডি প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা

হুন্ডি প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো একত্রে কাজ করছে।

৭. বিনিয়োগে উৎসাহ

দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য প্রবাসীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের রেমিট্যান্স খাতের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের রেমিট্যান্স খাত বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারলে এই খাতের সম্ভাবনা অনেক বেশি।

চ্যালেঞ্জসমূহ

  1. হুন্ডি বা অবৈধ অর্থ স্থানান্তর
  2. প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধার অভাব
  3. দক্ষ জনশক্তির অভাব
  4. রেমিট্যান্স পাঠানোর উচ্চ খরচ

সম্ভাবনা

  1. বৈশ্বিক চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারলে রেমিট্যান্স আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।
  2. প্রযুক্তিনির্ভর পেশা যেমন ফ্রিল্যান্সিং, আইটি খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ হলে এই খাত থেকে অর্জিত মুদ্রার পরিমাণ বাড়বে।
  3. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে।

শেষ কথা

রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ। এটি কেবল আর্থিক উন্নয়নের মাধ্যম নয়, বরং মানুষের জীবনমান উন্নত করতেও কার্যকর। প্রবাসীদের অবদান দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তোলে। রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বাড়াতে সরকারের পাশাপাশি প্রবাসী, ব্যাংকিং চ্যানেল এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত খাতে আরও জোর দিয়ে এবং বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবাহ বাড়িয়ে বাংলাদেশ তার অর্থনীতিতে আরও বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।

FAQ ‘s

রেমিট্যান্স অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান কত?

২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৮ম।

২০২২-২৩ অর্থবছরে কোন দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে?

সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে কোন জেলায়?

ঢাকা বিভাগ সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে।

কেন হুন্ডি পদ্ধতি দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর?

হুন্ডি একটি অবৈধ পদ্ধতি, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে প্রভাব ফেলে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ফ্রিল্যান্সিং কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?

ফ্রিল্যান্সাররা অনলাইনে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে, যা দেশের রেমিট্যান্স খাতকে আরও সমৃদ্ধ করে।

রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং বৈধ উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ নিশ্চিত করা বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি। এই খাতে আরও উদ্ভাবনী পরিকল্পনা এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top