২০২৫ সালে বাবা দিবস উদযাপিত হবে ১৫ জুন, যা ক্যালেন্ডারের সাধারণ একটি তারিখের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ বহন করে। এটি এমন এক উপলক্ষ, যেখানে সন্তানরা থেমে যায়, পেছনে তাকায়, এবং উপলব্ধি করে বাবার নিরব, ত্যাগী, এবং শক্তিময় ভূমিকার গভীরতা।
বিশ্বজুড়ে এই দিনটি পালিত হয় জুন মাসের তৃতীয় রবিবারে, যা ২০২৫ সালেও ব্যতিক্রম নয়। যদিও কিছু দেশ নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে ভিন্ন তারিখ বেছে নিয়েছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
বাবা দিবসের উৎপত্তি ও ইতিহাস
প্রত্যেক মহান উৎসব বা দিবসের পেছনে থাকে এক মানবিক গল্প। বাবা দিবসও এর ব্যতিক্রম নয়। এর সূত্রপাত ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে, বিশ শতকের প্রথম দিকে।
সোনোরা স্মার্ট ডডের অনুপ্রেরণাদায়ক উদ্যোগ
বাবা দিবস পালনের পেছনের মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন সোনোরা স্মার্ট ডড নামে এক তরুণী। তাঁর বাবা, উইলিয়াম জ্যাকসন স্মার্ট, ছিলেন এক সাহসী ও আত্মত্যাগী মানুষ—একজন সিঙ্গেল প্যারেন্ট, যিনি তাঁর ছয় সন্তানকে একাই বড় করে তুলেছিলেন।
১৯০৯ সালের এক বসন্ত সকালে, মা দিবস উপলক্ষে একটি বক্তব্য শুনতে গিয়ে সোনোরার মনে প্রশ্ন জাগে—“যদি মায়েদের ভালোবাসা উদযাপনের জন্য একটি দিন থাকতে পারে, তবে বাবাদের প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য একটি দিন কেন থাকবে না?”
এই ভাবনা থেকেই তিনি বাবা দিবস উদযাপনের প্রস্তাব দেন, এবং প্রথম উদযাপনটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯১০ সালের ১৯ জুন, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন রাজ্যের স্পোকেন শহরে।
সরকারি স্বীকৃতি ও বিশ্বব্যাপী বিস্তার
যদিও শুরুতে এটি সীমিত পরিসরে পালিত হয়েছিল, ধীরে ধীরে এই দিনটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
- ১৯৬৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন জুন মাসের তৃতীয় রবিবারকে “Father’s Day” হিসেবে ঘোষণা করেন।
- পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিকসন এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি দেন।
সেই থেকে প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবারে পৃথিবীর নানা প্রান্তে এই দিনটি পালিত হচ্ছে—কখনো পরিপূর্ণ উৎসবের আবহে, কখনো নিভৃত কৃতজ্ঞতার আবেশে।
বাবা দিবস উদযাপনের বহুমাত্রিক রূপ
পৃথিবীর প্রতিটি দেশ, প্রতিটি পরিবার নিজস্ব সংস্কৃতি ও অনুভূতি দিয়ে এই দিনটিকে রাঙিয়ে তোলে। বাবা দিবস উদযাপনের ধরণে যেমন বৈচিত্র্য আছে, তেমনি প্রতিটি রীতির পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর আবেগ ও শ্রদ্ধা।
১. ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে উপহার প্রদান
বাবা দিবস মানেই উপহার দেওয়ার উচ্ছ্বাস। এটি হতে পারে একটি ক্লাসিক ঘড়ি, একটি প্রিয় বই, বাবার পছন্দের পারফিউম, বা এমনকি নিজের হাতে তৈরি কোনো কার্ড—উপহারটি বড় না হলেও তার ভেতরে থাকে কৃতজ্ঞতার গভীর বার্তা।
আজকের যুগে অনেকেই পার্সোনালাইজড গিফট দিতে ভালোবাসেন, যেমন বাবার নাম খোদাই করা একটি কলম, বা বাবার ছবিসহ একটি মগ। এই ছোট্ট জিনিসগুলোও বাবার মুখে এনে দেয় অনন্য হাসি।
২. বাবার প্রিয় খাবারের আয়োজন
খাবার এমন এক মাধ্যম যা হৃদয়ের গভীর অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। অনেক পরিবারে এই দিনে বাবার সবচেয়ে প্রিয় রান্না তৈরি করা হয়। কেউ কেউ আবার বাইরে ডিনারে যায়, আবার কেউ ঘরে বসেই পারিবারিক ভোজের আয়োজন করে।
এই বিশেষ আয়োজনে শুধু খাবার নয়—থাকে আলাপচারিতা, স্মৃতি রোমন্থন, এবং একসাথে থাকার আনন্দ।
৩. স্মৃতিচারণ ও আবেগের পুনরুজ্জীবন
বাবার সঙ্গে কাটানো ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই একসময় হয়ে ওঠে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি। তাই এই দিনে অনেকে পুরনো ছবির অ্যালবাম খুলে বসেন, পুরনো ভিডিও দেখেন, কিংবা বাবার বলা গল্পগুলো আবার শোনেন।
স্মৃতি রোমন্থনের মাধ্যমে সন্তানরা বাবার জীবনের সংগ্রাম ও ত্যাগ নতুনভাবে উপলব্ধি করে।
৪. একসাথে সময় কাটানো ও বিশেষ কার্যক্রম
অনেকেই বাবা দিবসকে একটি এক্সক্লুসিভ bonding day হিসেবে ব্যবহার করেন। কেউ বাবার সঙ্গে ফিশিংয়ে যান, কেউ হাইকিংয়ে, কেউ আবার বাবার প্রিয় সিনেমা দেখে।
আজকের ব্যস্ত জীবনে যেখানে একসাথে বসার সময়ই পাওয়া যায় না, সেখানে এই দিনটি হয়ে ওঠে সম্পর্কের পুনর্জাগরণের সুযোগ।
বাবা দিবসের গুরুত্ব
বাবা শুধু পরিবারে অর্থ উপার্জনের মানুষ নন; তিনি এক দিকনির্দেশক, রক্ষক, ও বন্ধুর ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নিরব উপস্থিতিই আমাদের আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি।
পিতৃত্ব মানে শুধু দায়িত্ব নয়, অনুভূতি
সমাজে অনেক সময় পিতৃত্বকে কঠোরতা ও নিয়মের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু আধুনিক যুগে পিতৃত্ব মানে সহানুভূতি, অংশগ্রহণ ও মানসিক সমর্থন।
একজন বাবা সন্তানের প্রথম নায়ক। তিনি শেখান কীভাবে পড়ে গিয়েও উঠে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে বিপদের মুখে শান্ত থাকতে হয়।
বাবার অবদান
যেভাবে একজন স্থপতি চোখে না পড়ে ভবনের ভিত্তি তৈরি করেন, তেমনি একজন বাবা পরিবারের আবেগ, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার অদৃশ্য স্থপতি।
তিনি প্রায়শই নিজের চাহিদাকে পিছনে সরিয়ে রাখেন, যেন সন্তানরা তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে।
বাবা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—তাঁদের এই নীরব ত্যাগ ও অবদান কখনও অবহেলার যোগ্য নয়।
এই বৈচিত্র্যই প্রমাণ করে—পিতৃত্ব কোনো জাতি, ভাষা বা ধর্মের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নয়; এটি মানবতার সার্বজনীন অনুভূত
বাবা দিবসে করণীয় কিছু সুন্দর উদ্যোগ
বাবাকে খুশি করার জন্য সবসময় ব্যয়বহুল উপহার প্রয়োজন হয় না। নিচে কিছু অর্থবহ উদ্যোগের উল্লেখ করা হলো যা আপনার দিনটিকে আরও স্মরণীয় করে তুলতে পারে—
- নিজ হাতে লেখা একটি চিঠি দিন, যেখানে আপনি বাবার প্রতি আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন।
- পুরনো অ্যালবাম সাজিয়ে দিন, তাতে বাবার প্রিয় ছবিগুলো যুক্ত করুন।
- বাবার সঙ্গে একটি দিন কাটান, মোবাইল বা সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিরতি নিয়ে শুধুই তাঁকে সময় দিন।
- বাবার প্রিয় গান গেয়ে শুনান, অথবা তাঁর প্রিয় সিনেমাটি একসাথে দেখুন।
- তাঁর জীবনের গল্প শুনুন, কারণ বাবারা প্রায়ই তাদের অভিজ্ঞতা বলতে চান, শুধু শ্রোতা প্রয়োজন।
শেষ কথা
বাবা দিবস কেবল একটি দিন নয়; এটি এমন এক অনুভূতি, যা প্রতিদিনের জীবনে বয়ে বেড়ায়। ২০২৫ সালের ১৫ জুন, যখন সূর্য উঠবে, তখন অনেক ঘরে একসাথে বসে সন্তানেরা বাবার হাত ধরে বলবে—“তুমি শুধু আমার বাবা নও, তুমি আমার প্রথম বন্ধু, প্রথম শিক্ষক, আর চিরকালীন শক্তির উৎস।”
এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনের প্রতিটি সাফল্যের পেছনে এক জোড়া শক্ত হাত ছিল, যারা হয়তো কখনও প্রশংসা চায়নি, কিন্তু সবসময় ছায়ার মতো পাশে থেকেছে। তাই আসুন, এই বাবা দিবসে আমরা শুধু উপহার নয়, সময়, ভালোবাসা ও সম্মান দিই। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপহার হলো—একজন বাবার হাসি।