মাথা ঘোরা বা ভার্টিগো (Vertigo) এমন একটি অবস্থা যা শুধু শরীরিক অস্বস্তিই তৈরি করে না, অনেক সময় এটি দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক ছন্দকে পুরোপুরি ব্যাহত করে দেয়। এই অনুভূতিটি যেন চারপাশ ঘুরছে, কিংবা নিজের শরীর দুলছে — এমন এক বিভ্রান্তিকর অভিজ্ঞতা যা রোগীর ভারসাম্য ও আত্মবিশ্বাস উভয়কেই নষ্ট করতে পারে।
এই সমস্যার পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে অভ্যন্তরীণ কানের সমস্যা, রক্ত সঞ্চালনে ঘাটতি, স্নায়বিক গোলযোগ, এমনকি মানসিক চাপও। মাথা ঘোরার প্রকৃতি হতে পারে ক্ষণস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী, হালকা বা তীব্র।
এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো—
মাথা ঘোরা বা ভার্টিগোর সম্ভাব্য কারণসমূহ
শরীরে কীভাবে এটি প্রভাব ফেলে
কোন লক্ষণগুলো উপেক্ষা করা বিপজ্জনক
ঘরোয়া ও চিকিৎসাগত সমাধান
এবং সর্বশেষে, কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি
মাথা ঘোরা বা ভার্টিগোর সাধারণ কারণসমূহ
মাথা ঘোরা একটি বহুমাত্রিক সমস্যা — তাই এর পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। নীচে আমরা ধাপে ধাপে প্রতিটি কারণ ব্যাখ্যা করেছি।
১. অভ্যন্তরীণ কানের সমস্যা
অভ্যন্তরীণ কান আমাদের দেহের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণের প্রধান কেন্দ্র। এখানে অবস্থিত ভেস্টিবুলার সিস্টেম (Vestibular System) আমাদের মাথা, চোখ ও শরীরের অবস্থান সম্পর্কে মস্তিষ্ককে সংকেত দেয়। যখন এই সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটে, তখনই মাথা ঘোরা শুরু হয়।
ক. বিনাইন প্যারক্সিসমাল পজিশনাল ভার্টিগো (BPPV)
BPPV হচ্ছে সবচেয়ে প্রচলিত ও হঠাৎ দেখা দেওয়া ভার্টিগোর কারণ। এটি ঘটে যখন অভ্যন্তরীণ কানের ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের ছোট স্ফটিকগুলো (otoconia) তাদের স্বাভাবিক স্থান থেকে সরে গিয়ে তরলভর্তি নালিতে চলে যায়।
এর ফলে মস্তিষ্কে ভুল সংকেত যায় — শরীর স্থির থাকলেও মনে হয় যেন ঘুরছে।
লক্ষণ:
- মাথা ঘুরে যাওয়া (বিশেষত মাথা নড়ালে)
- বমি বমি ভাব
- ভারসাম্য হারানো
- কয়েক সেকেন্ড থেকে মিনিটব্যাপী অস্বস্তি
কারণ:
- হঠাৎ মাথার অবস্থান পরিবর্তন
- বয়স্কদের মধ্যে কানের গঠন দুর্বল হওয়া
- আঘাত বা কানের ইনফেকশন
খ. মেনিয়ারের রোগ (Ménière’s Disease)
এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল রোগ, যেখানে অভ্যন্তরীণ কানে তরল জমে গিয়ে চাপ সৃষ্টি করে।
প্রধান উপসর্গ:
- পুনরাবৃত্ত মাথা ঘোরা
- কানে ভোঁতা বা গুঞ্জন শব্দ (Tinnitus)
- শ্রবণশক্তি হ্রাস
- কানের ভার বা চাপের অনুভূতি
এই রোগটি কখনও সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়, তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
গ. ভেস্টিবুলার নিউরাইটিস (Vestibular Neuritis)
এটি একধরনের ভাইরাসজনিত সংক্রমণ যা ভেস্টিবুলার স্নায়ুকে আক্রান্ত করে।
ফলে ভারসাম্য ও দিকনির্দেশের সংকেত মস্তিষ্কে সঠিকভাবে পৌঁছায় না।
উপসর্গ
- হঠাৎ তীব্র মাথা ঘোরা
- বমি ও অস্থিরতা
- চলাফেরায় অসুবিধা
- চোখে অস্বাভাবিক নড়াচড়া (nystagmus)
২. মাইগ্রেন ও মাথা ঘোরা
মাইগ্রেন কেবল মাথাব্যথা নয়; এটি একটি নিউরোভাসকুলার ডিসঅর্ডার, যা স্নায়ু ও রক্তনালীর জটিল প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ভার্টিগো সৃষ্টি করতে পারে।
এই অবস্থাকে বলা হয় Vestibular Migraine।
চিহ্নসমূহ
- মাথা ঘোরা, আলো বা শব্দে অস্বস্তি
- বমি বমি ভাব
- দৃষ্টিভ্রম
- মাথাব্যথা ছাড়াও ভারসাম্য হারানো
মাইগ্রেনজনিত ভার্টিগো সাধারণত কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হতে পারে, তবে পুনরাবৃত্তি হওয়ার প্রবণতা থাকে।
৩. রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা
মস্তিষ্কে যথাযথ রক্ত প্রবাহ না হলে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়, যা মাথা ঘোরা বা ঝিমঝিম ভাবের কারণ হতে পারে।
ক. লো ব্লাড প্রেসার (Hypotension)
হঠাৎ ব্লাড প্রেসার কমে গেলে বা দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রক্তপ্রবাহ হ্রাস পেলে মাথা ঘোরা দেখা দেয়। এটি Orthostatic Hypotension নামে পরিচিত।
খ. হৃদরোগ (Cardiac Disorders)
হৃদয়ের অনিয়মিত স্পন্দন, কার্ডিওমায়োপ্যাথি, কিংবা হার্ট ব্লক — এগুলো রক্তপ্রবাহে ব্যাঘাত ঘটিয়ে মস্তিষ্কে রক্তের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, ফলে মাথা ঘোরা হয়।
৪. মানসিক ও স্নায়বিক কারণ
ক. উদ্বেগ ও প্যানিক অ্যাটাক
মানসিক চাপ ও উদ্বেগ শরীরে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন হরমোনের অস্থিরতা তৈরি করে। এর ফলে শ্বাসকষ্ট, ঘাম, এবং মাথা ঘোরা অনুভূত হতে পারে।
খ. স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা (Neurological Disorders)
মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (MS), পারকিনসন্স রোগ, অথবা ব্রেইন টিউমারের মতো জটিল অবস্থায় মস্তিষ্কের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে মাথা ঘোরা, চলাফেরায় দুর্বলতা ও দৃষ্টিবিভ্রম দেখা দেয়।
৫. ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
কিছু ওষুধ, বিশেষত অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টি-এপিলেপটিক, ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রক বা সেডেটিভ ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে মাথা ঘোরা দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এসব ওষুধ বন্ধ করা উচিত নয়, তবে ডোজ বা বিকল্প ওষুধের বিষয়ে চিকিৎসক নির্দেশ দিতে পারেন।
৬. ডিহাইড্রেশন ও পুষ্টির ঘাটতি
শরীরে পানি ও ইলেকট্রোলাইটের অভাব হলে রক্তচাপ কমে যায়, এবং মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় না। ফলে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা ও ক্লান্তি দেখা দেয়।
এছাড়া নিচের ঘাটতিগুলোও প্রভাব ফেলতে পারে:
- আয়রন ঘাটতি (রক্তাল্পতা)
- ভিটামিন বি১২-এর অভাব
- নিম্ন রক্তে শর্করা (Hypoglycemia)
৭. অন্যান্য কারণ
- মাথায় আঘাত বা ইনজুরি: ব্রেইন কনকাশন বা ট্রমা মাথা ঘোরা সৃষ্টি করতে পারে।
- অ্যালার্জি: কিছু অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া (যেমন পোলেন বা ধুলা) অভ্যন্তরীণ কানের চাপ বাড়িয়ে মাথা ঘোরাতে পারে।
- ঘাড়ের সমস্যা: সার্ভিকাল স্পন্ডিলোসিসে স্নায়ু চাপে মাথা ঘোরা দেখা যায়।
ঘরোয়া প্রতিকার ও জীবনযাপনের পরামর্শ
মাথা ঘোরা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে জীবনযাপন ও অভ্যাসের পরিবর্তন বড় ভূমিকা রাখে। কিছু সহজ পদক্ষেপ নিতে পারেন—
পর্যাপ্ত পানি পান করুন
প্রতিদিন অন্তত ২-৩ লিটার বিশুদ্ধ পানি পান করা জরুরি। ডিহাইড্রেশনই অনেক সময় মাথা ঘোরার মূল কারণ।
পুষ্টিকর খাবার খান
সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন যাতে থাকে ভিটামিন, খনিজ ও প্রোটিন। বিশেষ করে—
- সবুজ শাকসবজি
- ফলমূল
- বাদাম ও মাছ
- আয়রন ও বি১২ সমৃদ্ধ খাবার
পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম
মানসিক চাপ কমাতে পর্যাপ্ত ঘুম অপরিহার্য। ঘুমের অভাব স্নায়ুতে ক্লান্তি সৃষ্টি করে যা ভার্টিগোর প্রবণতা বাড়ায়।
মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখুন
ধ্যান, যোগব্যায়াম, গভীর শ্বাস নেওয়া—এই পদ্ধতিগুলো উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন এড়িয়ে চলুন
হঠাৎ উঠে দাঁড়ানো বা দ্রুত মাথা ঘোরানো থেকে বিরত থাকুন।
চিকিৎসা ও থেরাপি
যখন ঘরোয়া উপায় কার্যকর না হয় বা উপসর্গ দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন চিকিৎসা প্রয়োজন।
১. ওষুধ
- অ্যান্টিহিস্টামিনস: যেমন মেকলিজিন (Meclizine) মাথা ঘোরা কমায়।
- বেটাহিস্টিন: মেনিয়ারের রোগে ব্যবহৃত হয়।
- অ্যান্টিমেটিকস: বমি ভাব নিয়ন্ত্রণে রাখে।
২. ভেস্টিবুলার রিহ্যাবিলিটেশন থেরাপি (VRT)
এটি একধরনের ব্যায়ামভিত্তিক থেরাপি, যেখানে বিশেষজ্ঞ রোগীর ভারসাম্য ও সমন্বয় ক্ষমতা পুনর্গঠনের প্রশিক্ষণ দেন।
বিশেষ করে BPPV রোগীদের জন্য এটি অত্যন্ত কার্যকর।
৩. শল্য চিকিৎসা
অতি জটিল অভ্যন্তরীণ কানের ক্ষেত্রে, যেমন ক্রনিক মেনিয়ারের রোগে, সার্জারির মাধ্যমে তরল নিয়ন্ত্রণ করা হতে পারে।
প্রতিরোধের উপায় ভারসাম্য রক্ষার বিজ্ঞান
১. নিয়মিত ব্যায়াম করুন – হাঁটা, সাঁতার, বা যোগাভ্যাস ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে।
২. ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করুন – এগুলো স্নায়ু ও রক্তপ্রবাহে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
৩. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টে মনোযোগ দিন – মানসিক প্রশান্তিই শরীরের ভারসাম্যের চাবিকাঠি।
৪. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান – রক্তচাপ, রক্তে শর্করা ও কানের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ জরুরি।
শেষ কথা
মাথা ঘোরা অনেক সময় ক্ষণস্থায়ী মনে হলেও এটি শরীরের গভীর কোনো সমস্যার সংকেত হতে পারে। তাই অবহেলা না করে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সঠিক জীবনযাপন, পর্যাপ্ত পানি পান, মানসিক প্রশান্তি ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা—এই চারটি বিষয়কে মেনে চললে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাথা ঘোরার সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।