বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত জমি কেনাবেচা হচ্ছে। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ তাদের জমি বিক্রি করেন আবার কেউ নতুন জমি কিনে থাকেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জমির মালিকানা বদল হয়। রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লিখনের মাধ্যমে যখন আপনি জমি ক্রয় করেন, তখন সেটি আপনার নামে দলিলভুক্ত হয়। কিন্তু শুধু দলিল আপনার নামে থাকলেই জমির পূর্ণ মালিকানা নিশ্চিত হয় না। জমির প্রকৃত মালিক হিসেবে সরকারি নথিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হলে আপনাকে করতে হবে জমি খারিজ বা নামজারি।
অনেকেই “নামজারি”, “খারিজ”, অথবা “জমি একত্রিতকরণ” শব্দগুলো নিয়ে বিভ্রান্ত থাকেন। আসলে এগুলো একই প্রক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন নাম। নামজারি মূলত একটি আইনি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জমির দলিলের পর আপনার নাম সরকারিভাবে জমির মালিক হিসেবে নিবন্ধিত হয়।
এই দীর্ঘ আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব—
- জমি খারিজ বা নামজারি আসলে কী,
- এর গুরুত্ব,
- খরচের পরিমাণ,
- অনলাইনে নামজারি করার নিয়ম,
- দালাল বা মুহুরীর মাধ্যমে কাজ করলে ঝুঁকি,
- প্রয়োজনীয় কাগজপত্র,
- সময়সীমা,
- এবং সরকারি ফি ও আনুষঙ্গিক খরচ।
চলুন ধাপে ধাপে বিষয়গুলো জেনে নেওয়া যাক।
জমি খারিজ বা নামজারি কী?
জমি খারিজ হলো এমন একটি আইনি প্রক্রিয়া যেখানে দলিলের মালিকের নাম সংশোধন বা পরিবর্তন করে সরকারি রেকর্ডে নতুন মালিকের নাম নিবন্ধিত করা হয়। আপনি যদি নতুন করে জমি কিনে থাকেন, উত্তরাধিকার সূত্রে জমি পেয়ে থাকেন, অথবা দানপত্রের মাধ্যমে জমি গ্রহণ করেন, সবক্ষেত্রেই খারিজ করতে হয়।
এটি মূলত সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি যে, নির্দিষ্ট ওই জমির প্রকৃত মালিক আপনি। ফলে কর প্রদান, জমির দলিল সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ যে কোনো কাজ কিংবা ব্যাংক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনার নামই কার্যকর হবে।
জমি খারিজের প্রয়োজনীয়তা
অনেকেই দলিল করার পর খারিজ করতে গড়িমসি করেন। কিন্তু এটি না করলে ভবিষ্যতে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। নামজারির প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:
- সরকারি রেকর্ডে আপনার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়।
- ভবিষ্যতে জমি বিক্রি করতে চাইলে সমস্যা হবে না।
- জমি সংক্রান্ত কোনো বিরোধ দেখা দিলে আপনার প্রমাণ শক্তিশালী হবে।
- ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ, হাউজিং ঋণ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা নিতে হলে খতিয়ান প্রয়োজন।
- কর পরিশোধের ক্ষেত্রে সরাসরি আপনার নামে রসিদ পাওয়া যায়।
জমি খারিজে খরচ কত?
অনেকেই ভেবে থাকেন জমি খারিজে প্রচুর টাকা লাগে। কেউ কেউ আবার দালালদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে ফেলেন। অথচ বাস্তবে সরকারি ফি খুবই সীমিত।
সরকারি ফি অনুযায়ী খরচ
- নামজারি ফি: 1,150 টাকা
- কোর্টফি স্ট্যাম্প: 20 টাকা
 মোট সরকারি খরচ = 1,170 টাকা
এছাড়াও অনলাইনে আবেদন করার সময় ইন্টারনেট বা স্ক্যানিং খরচ সামান্য যোগ হতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- জমির আয়তন যত বড়ই হোক না কেন, খারিজের ফি সমান থাকবে।
- বেশি খাজনা দিতে হতে পারে, তবে নামজারির ফি বাড়বে না।
- কারও কাছে যদি অতিরিক্ত টাকা দাবি করা হয়, তবে বুঝবেন সেটি দালাল বা মুহুরীর খেলা।
অনলাইনে জমি খারিজ করার নিয়ম
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার land.gov.bd এর মাধ্যমে অনলাইনে ই-নামজারি করার সুযোগ চালু করেছে। এর ফলে দালালের কাছে যাওয়ার ঝামেলা ছাড়াই ঘরে বসেই জমির নামজারি করা সম্ভব।
ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া
- land.gov.bd এ প্রবেশ করুন।
- “ই-নামজারি আবেদন” অপশনে ক্লিক করুন।
- প্রয়োজনীয় তথ্য যেমন দলিল নম্বর, রেজিস্ট্রি অফিস, মৌজা, খতিয়ান ইত্যাদি পূরণ করুন।
- প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্ক্যান করে আপলোড করুন।
- ফি অনলাইনে পরিশোধ করুন।
- আবেদন সফলভাবে জমা হলে একটি রিসিপ্ট পাবেন।
- নির্ধারিত সময়ে স্থানীয় ভূমি অফিসে যাচাই-বাছাই শেষে আপনার নামে খারিজ সম্পন্ন হবে।
জমি খারিজের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
জমি খারিজ করতে গেলে কয়েকটি ডকুমেন্ট অবশ্যই লাগবে। এগুলো ঠিকমতো প্রস্তুত না করলে আবেদন ঝুলে যেতে পারে।
- মূল দলিলের কপি
- ক্রেতা/উত্তরাধিকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র (NID)
- বিক্রেতার জাতীয় পরিচয়পত্র
- রেজিস্ট্রি কপি
- খাজনার রসিদ
- পাসপোর্ট সাইজ ছবি
- পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (প্রযোজ্য হলে)
সময়সীমা
অনলাইনে আবেদন করার পর সাধারণত ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে জমি খারিজ সম্পন্ন হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় ভূমি অফিসের কাজের চাপ বা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার কারণে সময় কিছুটা বেশি লাগতে পারে।
দালালের মাধ্যমে জমি খারিজের ঝুঁকি
বাংলাদেশে ভূমি অফিস সংশ্লিষ্ট অনেকেই দালালদের মাধ্যমে খারিজ করাতে অভ্যস্ত। তারা মনে করেন এতে কাজ দ্রুত হবে। বাস্তবে এর উল্টো হয়—
- অতিরিক্ত টাকা দাবি করা হয়।
- অনেক সময় অসম্পূর্ণ কাজ করে ফেলে।
- ফাইল ঝুলিয়ে রেখে বছরের পর বছর ভোগান্তিতে ফেলে।
তাই সরাসরি অনলাইনে আবেদন করাই শ্রেয়।
জমি খারিজে সাধারণ ভুল ও সতর্কতা
- ভুল বা অসম্পূর্ণ কাগজপত্র জমা না দেওয়া।
- জমির খাজনা বকেয়া থাকা।
- ভুল মৌজা বা খতিয়ান নম্বর উল্লেখ করা।
- দালালের কাছে কাজ হস্তান্তর করা।
শেষ কথা
বাংলাদেশে জমি কেনাবেচা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু জমি ক্রয়ের পর যদি নামজারি না করা হয়, তবে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী জমি খারিজ করতে খরচ মাত্র 1,170 টাকা। এর বাইরে অতিরিক্ত খরচ চাইলে বুঝতে হবে সেটি দালালদের ফাঁদ।
বর্তমান সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে ঘরে বসেই জমি খারিজের আবেদন করা সম্ভব। তাই দালালের ওপর নির্ভর না করে নিজেই জমি খারিজের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সবচেয়ে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী উপায়।



