বাংলাদেশে সরকারি চাকরি সবসময়ই সম্মান, স্থায়িত্ব এবং আর্থিক নিরাপত্তার অন্যতম প্রতীক। আর এই চাকরির ভেতরেও বিভিন্ন গ্রেডে পার্থক্য বিদ্যমান। বর্তমান সময়ে সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয় হলো ১১ তম গ্রেডের চাকরি। একদিকে এটি তৃতীয় শ্রেণীর চাকরির প্রথম ধাপ, অন্যদিকে এর প্রতিযোগিতা এতটাই কঠিন যে হাজারো প্রার্থী এক আসনের জন্য লড়াই করে থাকেন।
এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে জানব ১১ তম গ্রেডের বেতন কাঠামো, ভাতা, বোনাস, সুবিধা, যোগ্যতা এবং বাস্তব চিত্র।
১১ তম গ্রেডের চাকরি প্রতিযোগিতা ও চাহিদা
বাংলাদেশে ১১ তম গ্রেডের চাকরি পাওয়া এখন “আকাশ ছোঁয়া” ব্যাপার। একটি মাত্র শূন্যপদে শত শত প্রার্থী অংশ নেয়। এর কারণ হলো সরকারি চাকরির নিরাপত্তা, আর্থিক সুবিধা এবং অবসরকালীন প্রাপ্ত বিভিন্ন সুবিধা।
আজ থেকে কয়েক দশক আগে যেখানে তৃতীয় শ্রেণীর চাকরি পাওয়া তুলনামূলক সহজ ছিল, বর্তমানে সেই জায়গায় ১১ তম গ্রেডের মতো চাকরিতে প্রবেশ করার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে পড়াশোনা, প্রস্তুতি ও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়।
২০১৫ সালের সরকারি গ্যাজেট ও বেতন কাঠামোর পরিবর্তন
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ১০টি গ্রেড নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে নানা বৈষম্য থেকে যায়। পরে ২০১৫ সালে সরকার নতুন গ্যাজেট পাস করে মোট ২০টি গ্রেড নির্ধারণ করে। এর মাধ্যমে একদিকে বৈষম্য হ্রাস পায়, অন্যদিকে বেতন ও সুবিধাগুলো সুসংগঠিতভাবে সাজানো হয়।
এই গ্যাজেট অনুযায়ী:
- ১১ তম গ্রেডের শুরুর মূল বেতন: ১২,৫০০ টাকা
- সর্বোচ্চ মূল বেতন: ৩২,২৪০ টাকা
- প্রতি বছর ৫% ইনক্রিমেন্ট যোগ হয়ে বেতন সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়।
১১ তম গ্রেডের বেতন স্কেল
১১ তম গ্রেডে কর্মরত কর্মকর্তারা নিম্নোক্ত ধাপে ধাপে বেতন পান:
স্কেল:
১২৫০০ – ১৩১৩০ – ১৩৭৯০ – ১৪৪৮০ – ১৫২১০ – ১৫৯৮০ – ১৬৭৮০ – ১৭৬২০ – ১৮৫১০ – ১৯৪৪০ – ২০৪২০ – ২১৪৫০ – ২২৫৩০ – ২৩৬৬০ – ২৪৮৫০ – ২৬১০০ – ২৭৪১০ – ২৮৭৯০ – ৩০২৩০ – ৩২২৪০ টাকা।
১১ তম গ্রেড কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত?
পূর্বে চাকরিগুলো শ্রেণীভিত্তিক ভাগ করা হতো। বর্তমানে গ্রেডভিত্তিক হলেও, চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত রয়েছে।
- ১১ তম গ্রেড হলো তৃতীয় শ্রেণীর চাকরির সূচনা বিন্দু।
- ১৬ তম গ্রেড পর্যন্ত এটি বিস্তৃত।
- অর্থাৎ ১১ তম থেকে ১৬ তম গ্রেডের মধ্যে যেকোনো চাকরি তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
১১ তম গ্রেডে সর্বসাকুল্যে বেতন
মূল বেতন ছাড়াও বিভিন্ন ভাতা যুক্ত হয়ে একজন কর্মকর্তার সর্বমোট মাসিক আয় দাঁড়ায় প্রায় ২০,১২৫ টাকা।
বিভাজন
- মূল বেতন: ১২,৫০০ টাকা
- বাড়িভাড়া ভাতা: ৫৬২৫ টাকা (ঢাকায় ৬০%, অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনে ৫০%, অন্যত্র ৪৫%)
- মেডিকেল ভাতা: ১,৫০০ টাকা
- টিফিন ভাতা: ২০০ টাকা
- যাতায়াত ভাতা: ৩০০ টাকা
মোট = ২০,১২৫ টাকা
অবশ্য এই মোট বেতন থেকে কিছু অংশ ভবিষ্যৎ অবসর ভাতার জন্য কর্তন করা হয়।
১১ তম গ্রেডে শিক্ষা সহায়তা ভাতা
শিক্ষা ভাতা সরকারি চাকরিজীবীদের অন্যতম বড় সুবিধা।
- একজন সন্তান থাকলে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা।
- দুটি সন্তান থাকলে সর্বোচ্চ ১,০০০ টাকা।
- তবে দুই সন্তানের বেশি হলে অতিরিক্ত ভাতা প্রযোজ্য নয়।
১১ তম গ্রেডে বোনাস ও বৈশাখী ভাতা
একজন ১১ তম গ্রেডের কর্মকর্তা বছরে মোট তিনবার বোনাস পান।
- ঈদুল ফিতর → মূল বেতনের সমান (১২,৫০০ টাকা)
- ঈদুল আযহা → মূল বেতনের সমান (১২,৫০০ টাকা)
- বৈশাখী ভাতা → মূল বেতনের ২০%
১১ তম গ্রেডে চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা
সরকারি চাকরিতে ১১ তম গ্রেডের পদ পেতে হলে কিছু মৌলিক যোগ্যতা থাকতে হয়।
- ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি বা সমমান আবশ্যক।
- উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
- প্রতিযোগিতার কারণে যোগ্য প্রার্থীদের গভীর প্রস্তুতি এবং বিস্তৃত পড়াশোনা করতে হয়।
১১ তম গ্রেডে সুযোগ-সুবিধা
চাকরিজীবনে এবং অবসরের পরও ১১ তম গ্রেডের কর্মকর্তারা নানা সুবিধা ভোগ করে থাকেন।
চাকরির সময়
- মাসিক বেতন + ভাতা
- বার্ষিক তিনটি বোনাস
- শিক্ষা সহায়তা ভাতা
- চিকিৎসা ভাতা
অবসরের পর
- এককালীন মোটা অঙ্কের টাকা
- মূল বেতনের অর্ধেক হারে পেনশন
- নিয়মিত চিকিৎসা সুবিধা
কেন ১১ তম গ্রেডের চাকরির চাহিদা বাড়ছে?
বর্তমান বাংলাদেশের বেসরকারি চাকরির তুলনায় সরকারি চাকরিতে:
- চাকরির স্থায়িত্ব বেশি
- বেতন কাঠামো নির্দিষ্ট ও নিয়মিত বৃদ্ধি পায়
- অবসরকালীন সুবিধা নিশ্চিত
- সামাজিক সম্মান
এই সব কারণে ১১ তম গ্রেডের চাকরি এখন তরুণ প্রজন্মের কাছে স্বপ্নের সমান।
শেষ কথা
১১ তম গ্রেড বাংলাদেশের সরকারি চাকরির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এখানে চাকরি পাওয়া সহজ নয়, তবে সুযোগ-সুবিধা ও ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা এতটাই আকর্ষণীয় যে হাজারো প্রার্থী এর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকেন। সঠিক প্রস্তুতি, ধৈর্য ও উচ্চশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমেই কেবল একজন প্রার্থী এই গ্রেডে চাকরি লাভ করতে পারে।