মা দিবস কবে ২০২৫

মা”—এই এক অমোঘ শব্দে লুকিয়ে আছে অগণিত আবেগ, অকৃত্রিম ভালোবাসা, আর অনন্ত ত্যাগের ইতিহাস। জীবনের প্রথম শ্বাস নেওয়া থেকে শুরু করে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত, এক অদৃশ্য ছায়ার মতো মা তার সন্তানকে আচ্ছন্ন করে রাখেন স্নেহ, মমতা ও ত্যাগের মিশ্রণে।
তিনি শুধু একজন মানুষ নন—তিনি আশ্রয়, তিনি প্রথম শিক্ষক, তিনি নৈতিকতার প্রথম পাঠশালা। মায়ের কণ্ঠেই আমরা প্রথম শব্দ উচ্চারণ করি, তার হাতেই শিখি জীবনযাপনের প্রথম পাঠ, তার চোখেই দেখি পৃথিবীর আলো।

মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার তুলনা নেই। তিনি সেই যোদ্ধা যিনি প্রতিদিন জীবনযুদ্ধের ময়দানে লড়েন শুধুমাত্র সন্তানদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। যখন সন্তান অসুস্থ হয়, তিনি জেগে থাকেন নির্ঘুম রাত; যখন সন্তান সফল হয়, তার চোখে জল নামে আনন্দে।
মা যেন এক চিরন্তন নদী—যিনি সবসময় দেন, কিন্তু কখনও কিছু প্রত্যাশা করেন না।

ইসলামের দৃষ্টিতে মায়ের মর্যাদা জান্নাতের পথে প্রথম ধাপ

ইসলাম ধর্মে মায়ের মর্যাদা এতটাই উচ্চ যে কুরআন ও হাদিস উভয়েই বারবার তার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন—“মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত।”

এই হাদিসের গভীর তাৎপর্য হলো—যে সন্তান তার মাকে শ্রদ্ধা করে, সেবা করে, তাকে কষ্ট না দিয়ে ভালোবাসে, তার জন্য জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত হয়।
কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন—তোমার রব আদেশ করেছেন যে, তুমি তাঁরই ইবাদত করবে এবং পিতা-মাতার সাথে উত্তম ব্যবহার করবে।”
(সূরা বনি ইসরাঈল: আয়াত ২৩)

ইসলামে মায়ের ত্যাগের তুলনা করা হয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ মানবিকতার সঙ্গে। একজন মা নয় মাস গর্ভে সন্তান ধারণ করেন, কষ্ট সহ্য করেন, তারপরও তার মুখে অভিযোগ থাকে না। বরং তিনি আল্লাহর কাছে সন্তানের মঙ্গল প্রার্থনা করেন প্রতিটি নামাজে।
এই কারণেই ইসলাম মায়ের প্রতি ভালোবাসা, সম্মান ও সেবা করাকে শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবেও ঘোষণা করেছে।

মা দিবসের সূচনা ইতিহাসের পাতায় এক আবেগঘন আন্দোলন

আজ আমরা যে “মা দিবস” উদযাপন করি, তার ইতিহাসও এক অনন্য আবেগ ও সংগ্রামের গল্প।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে, ১৮৭০ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কবি ও নারীবাদী কর্মী জুলিয়া ওয়ার্ড হাও প্রথমবারের মতো মায়েদের সম্মানে একটি দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। তার লক্ষ্য ছিল সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মাতৃত্বের মূল্যবোধ তুলে ধরা।

যদিও তার প্রচেষ্টা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, কিন্তু তিনি মাতৃত্বকে সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিয়েছিলেন।
তার প্রায় তিন দশক পর, আনা জার্ভিস নামের এক তরুণ শিক্ষিকা নিজের প্রয়াত মা অ্যান মেরি রিভস জার্ভিস-এর স্মরণে ১৯০৫ সালে মা দিবস পালনের উদ্যোগ নেন।
তার মা ছিলেন এক সমাজসেবী নারী, যিনি গৃহযুদ্ধের সময় অসুস্থ ও দরিদ্রদের সেবায় নিবেদিত ছিলেন।

আনা জার্ভিস বিশ্বাস করতেন—প্রতিটি মা সম্মান পাওয়ার যোগ্য।
১৯০৮ সালে তিনি পশ্চিম ভার্জিনিয়ার অ্যান্ড্রুজ মেথডিস্ট চার্চে প্রথম আনুষ্ঠানিক মা দিবস উদযাপন করেন, যেখানে শত শত শিশু ও মা একত্রিত হয়েছিলেন।
তার আবেগপূর্ণ প্রচেষ্টা ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এক বিশ্বব্যাপী ভালোবাসার উৎসব

১৯১৪ সালে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন আনুষ্ঠানিকভাবে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে Mother’s Day বা মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
এ সিদ্ধান্তের পর শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশেও মা দিবস পালনের রীতি গড়ে ওঠে।

আজ বিশ্বের প্রায় ১০০টিরও বেশি দেশে মা দিবস উদযাপিত হয়—
যুক্তরাজ্যে এটি “Mothering Sunday” নামে পরিচিত, যা মূলত ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত।
ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দক্ষিণ এশীয় দেশেও মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস পালিত হয়।
থাইল্যান্ডে মা দিবস পালিত হয় রাণী সিরিকিতের জন্মদিনে, অর্থাৎ ১২ আগস্ট।
ইথিওপিয়া, জাপান, মেক্সিকো সহ আরও অনেক দেশে স্থানীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী দিন ও রীতিনীতিতে পার্থক্য থাকলেও মূল ভাব এক—মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

এই দিনটি এখন এক বৈশ্বিক আবেগের প্রতীক হয়ে উঠেছে, যেখানে জাতি, ধর্ম, ভাষা নির্বিশেষে সকলেই এক কণ্ঠে বলে—“ধন্য সেই মা, যিনি আমাদের জীবন দিয়েছেন।”

বাংলাদেশে মা দিবস ২০২৫ সময়, তারিখ ও তাৎপর্য

বাংলাদেশে মা দিবস এখন একটি আবেগঘন ও পারিবারিক উৎসবের রূপ নিয়েছে। যদিও আমাদের সংস্কৃতিতে প্রতিদিনই মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়, তবুও আন্তর্জাতিকভাবে এই দিনটি পালনের মাধ্যমে আমরা মায়ের অবদানকে নতুন করে স্মরণ করি।

২০২৫ সালে আন্তর্জাতিক মা দিবস পালিত হবে ১১ মে, রবিবারে।
এই দিনটি পড়েছে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গেও মিল রেখে উদযাপিত হবে।

এই দিনে সন্তানরা মাকে উপহার দেয়, ফুলে সাজায় ঘর, কেউ কেউ মায়ের প্রিয় খাবার রান্না করে, আবার কেউ নিয়ে যায় মাকে বাইরে কোথাও ঘুরতে।
স্কুল, কলেজ ও সামাজিক সংগঠনগুলো আয়োজন করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা আবৃত্তি, ও প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা—সবই মায়ের সম্মানার্থে।

মা দিবসের রীতিনীতি ও ভালোবাসা প্রকাশের নানান উপায়

মা দিবস কোনো নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি আমাদের মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এক উজ্জ্বল উপলক্ষ।
এই দিনে সন্তানেরা তাদের মাকে একটু বাড়তি ভালোবাসা, মনোযোগ ও যত্নের মাধ্যমে সম্মান জানায়।

মাকে দেওয়া যেতে পারে ছোট ছোট ভালোবাসার উপহার:
  • একটি হাতে লেখা চিঠি, যেখানে থাকবে আন্তরিক কৃতজ্ঞতার বার্তা।
  • প্রিয় ফুলের তোড়া, যা মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলবে।
  • একসাথে সময় কাটানো, যেমন সিনেমা দেখা, পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করা।
  • নিজ হাতে রান্না করা খাবার, কারণ মায়ের জন্য ভালোবাসা প্রকাশের সবচেয়ে সুন্দর মাধ্যম হলো যত্ন।

মায়ের ভূমিকা প্রথম শিক্ষক, প্রথম বন্ধু, প্রথম আশ্রয়

শিশু জন্মের পর প্রথম যে মুখটি দেখে, সেটি মায়ের।
প্রথম হাসি, প্রথম কান্না, প্রথম স্পর্শ—সব কিছুই জড়িয়ে থাকে মায়ের সঙ্গে।

তিনি শুধু গর্ভধারিণী নন; তিনি সন্তানের জীবনের প্রথম শিক্ষিকা।
তিনি শেখান—কীভাবে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে ক্ষমা করতে হয়, কীভাবে মানুষ হতে হয়।
তার শেখানো মূল্যবোধই পরবর্তীতে সন্তানের চরিত্র গঠনের ভিত হয়ে ওঠে।

একজন মা সন্তানের মধ্যে বিনয়, সততা, সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস জাগিয়ে তোলেন।
তিনি এমন এক দিশারী, যিনি সন্তানকে ভুল পথে যেতে দেন না, বরং নরম হাতে তাকে সঠিক পথের দিশা দেখান।

মায়ের ত্যাগ এক অদৃশ্য সংগ্রামের কাহিনি

একজন মা যেন পাহাড়ের মতো দৃঢ়, অথচ ফুলের মতো কোমল।
তিনি যে কষ্ট সহ্য করেন, তা অনেক সময় কেউ জানেই না।
রাত জেগে সন্তানের জ্বর দেখাশোনা, নিজের ক্ষুধা ভুলে সন্তানকে খাওয়ানো, নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়া—এই ত্যাগের হিসাব কোনো ভাষায় লেখা যায় না।

আজকের সফল মানুষরা যাদের মধ্যে বিনয়, অধ্যবসায়, ভালোবাসা ও দৃঢ়তা আছে—তাদের পেছনে কোনো না কোনো মায়ের নিরব অবদান লুকিয়ে থাকে।
একটি প্রবাদ আছে—

“পৃথিবীতে যদি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা খুঁজতে চাও, তবে তাকাও মায়ের চোখে।”

শেষ কথা

মা কোনো সম্পর্ক নয়—তিনি এক অনুভব, এক জীবনদীপ।
তিনি এমন এক ভালোবাসার উৎস, যা কখনো নিঃশেষ হয় না।
আমরা যেখানেই যাই, যত দূরেই যাই না কেন, মায়ের দোয়া আমাদের সঙ্গে থাকে এক অদৃশ্য ছায়ার মতো।

মা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মাকে ভালোবাসার জন্য আলাদা কোনো দিনের প্রয়োজন নেই।
তবুও এই দিনটি এক প্রতীক—যা আমাদের শেখায় কৃতজ্ঞ হতে, মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে, তার চোখে অশ্রু নয়, আলো দেখতে।

আসুন, আমরা প্রতিজ্ঞা করি—
প্রতিদিনকে করে তুলব মা দিবস, প্রতিটি কাজের মাধ্যমে জানাবো আমাদের অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র শব্দটি আজও একটাই—

“মা।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top