বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর কৌশলের অংশ হিসেবে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এই উদ্যোগের অন্যতম আলোচিত খাত হলো সিগারেট ও তামাকজাত পণ্য। সিগারেটের মূল্যস্তরভেদে নতুন শুল্কহার ও ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, যার ফলে খুচরা ও পাইকারি উভয় বাজারেই দাম বেড়েছে।
এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো—সিগারেটের নতুন দামের কাঠামো, ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির কারণ, বাজারে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব, ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ, স্বাস্থ্য ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ, রাজস্ব প্রাপ্তির সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি।
সরকারের নতুন পদক্ষেপ ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধির পটভূমি
২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে এসে সরকার বুঝতে পারে, নির্ধারিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বড় ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। বাজেট বাস্তবায়নে অর্থ সংগ্রহ নিশ্চিত করতে তাই দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন স্বাক্ষরিত একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে সিগারেটসহ শতাধিক পণ্যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়।
কেন সিগারেট খাতকে বেছে নেওয়া হলো?
- সিগারেট ও তামাকজাত দ্রব্য বাংলাদেশে সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদায়ক খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম।
- ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি হওয়ায়, কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তাৎক্ষণিক রাজস্ব আহরণের সম্ভাবনা প্রবল।
- স্বাস্থ্যগত কারণে তামাক পণ্যের ব্যবহার কমাতে আন্তর্জাতিক চাপও রয়েছে।
- সরকারের লক্ষ্য একদিকে রাজস্ব বৃদ্ধি, অন্যদিকে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা।
নতুন দামের কাঠামো খুচরা পর্যায়ে পরিবর্তন
সিগারেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন ভ্যাট ও শুল্ক পরিশোধ করে বাজারে নতুন দামের চালান ছাড়তে শুরু করেছে। ফলে খুচরা বাজারে প্রায় সব ধরনের সিগারেটের দাম বেড়েছে প্রতি শলাকায় ১ থেকে ২ টাকা পর্যন্ত।
ব্র্যান্ডভেদে খুচরা পর্যায়ের দাম
- বেনসন অ্যান্ড হেজেস (Benson & Hedges): আগে ১৮ টাকা, এখন ২০ টাকা
- গোল্ডলিফ (Gold Leaf): আগে ১৩ টাকা, এখন ১৫ টাকা
- লাকি স্ট্রাইক (Lucky Strike): আগে ১০ টাকা, এখন ১২ টাকা
- স্টার (Star): আগে ৯ টাকা, এখন ১০ টাকা
- ডার্বি, পাইলট ও হলিউড: আগে ৭ টাকা, এখন ৮ টাকা
- রয়েল (Royal): আগে ৬ টাকা, এখন ৭ টাকা
পাইকারি পর্যায়ে নতুন দাম
খুচরা বাজারের পাশাপাশি পাইকারি বাজারেও প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো নতুন দাম নির্ধারণ করেছে।
- বেনসন অ্যান্ড হেজেস (২০ শলাকা): ৩৭০ টাকা
- গোল্ডলিফ (২০ শলাকা): ২৮০ টাকা
- লাকি স্ট্রাইক (২০ শলাকা): ২১০ টাকা
- স্টার (২০ শলাকা): ১৭২ টাকা
- পাইলট, ডার্বি স্টাইল ও হলিউড (২০ শলাকা): ১৪৪ টাকা
- রয়েল (২০ শলাকা): ১২৬ টাকা
অতএব, পাইকারি পর্যায়ে প্রতিটি প্যাকেটের দাম গড়ে ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
চার স্তরের মূল্যমান এনবিআরের নতুন প্রজ্ঞাপন
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সিগারেটের দাম ও শুল্ক চার স্তরে বাড়ানো হয়েছে।
- নিম্নস্তর:
- দাম : ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা (১০ শলাকা)
- সম্পূরক শুল্ক : ৬০% থেকে ৬৭%
- মধ্যমস্তর:
- দাম : ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকা
- সম্পূরক শুল্ক : ৬৫.৫% থেকে ৬৭%
- উচ্চস্তর:
- দাম : ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৪০ টাকা
- সম্পূরক শুল্ক : ৬৫.৫% থেকে ৬৭%
- অতি উচ্চস্তর:
- দাম : ১৬০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮৫ টাকা
- সম্পূরক শুল্ক : ৬৫.৫% থেকে ৬৭%
প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর প্রতিক্রিয়া
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) বাংলাদেশ দেশের অন্যতম প্রধান রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান সাবাব আহমেদ চৌধুরী জানিয়েছেন—
- আকস্মিক নীতিগত পরিবর্তনের আগে সরকারের উচিত ছিল অংশীজনদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করা।
- হঠাৎ শুল্ক বাড়ানোর ফলে রাজস্ব ফাঁকি, চোরাই সিগারেট ও অবৈধ সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
- দীর্ঘমেয়াদে এই সিদ্ধান্ত সরকারের রাজস্ব আহরণকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
ভোক্তা পর্যায়ের প্রভাব
শুল্ক ও ভ্যাট বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়েছে ধূমপায়ীদের ওপর।
- নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য সিগারেট আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।
- অনেক ধূমপায়ী সস্তা ব্র্যান্ডে ঝুঁকতে পারেন।
- চোরাই ও অবৈধ সিগারেটের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে পারে।
- দীর্ঘমেয়াদে ধূমপানের হার কমার সম্ভাবনা তৈরি হলেও তা নির্ভর করছে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কার্যকারিতার ওপর।
স্বাস্থ্য ও সামাজিক প্রভাব
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) দীর্ঘদিন ধরে বলছে, তামাকজাত পণ্যে উচ্চ কর আরোপ করলে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। বাংলাদেশেও ধূমপান হ্রাসে করনীতির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- ধূমপান সংক্রান্ত রোগে দেশের চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে।
- সিগারেটের দাম বাড়লে তরুণ ও নতুন ধূমপায়ীরা নিরুৎসাহিত হবে।
- স্বাস্থ্যখাতে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
রাজস্ব আহরণের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
সম্ভাবনা
- ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধির ফলে স্বল্পমেয়াদে রাজস্ব প্রবাহ বাড়বে।
- বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকারের সহায়তা করবে।
চ্যালেঞ্জ
- অবৈধ সিগারেট বাজারে প্রবেশ করলে রাজস্ব ফাঁকি বাড়বে।
- সীমান্তবর্তী এলাকায় চোরাচালান বৃদ্ধি পেতে পারে।
- বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
- দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও তামাক পণ্যে কর বৃদ্ধি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
- ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা নিয়মিতভাবে সিগারেটের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করছে।
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ হলো—সিগারেটের খুচরা দামের অন্তত ৭০% কর হিসেবে নির্ধারণ করা।
শেষ কথা
২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে সিগারেটের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সরকারের রাজস্ব আহরণে স্বল্পমেয়াদী সুফল বয়ে আনবে। তবে এই পদক্ষেপের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য নির্ভর করছে—অবৈধ বাজার নিয়ন্ত্রণ, চোরাচালান প্রতিরোধ, এবং কার্যকর নীতি বাস্তবায়নের ওপর।
একদিকে রাজস্ব বৃদ্ধি, অন্যদিকে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন—এই দুই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সরকারকে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় করতে হবে।