প্রতিদিন শত শত বাংলাদেশি সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছেন, কেউ যাচ্ছেন কাজের সন্ধানে, কেউ যাচ্ছেন হজ্বের উদ্দেশ্যে আবার কেউ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। সৌদি আরবে কাজ করতে যাওয়া প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে অধিকাংশই জীবিকা নির্বাহের তাগিদে সেখানে যান। সৌদি আরবের অর্থনীতি শক্তিশালী এবং উন্নয়নশীল হওয়ায় এখানে বিভিন্ন সেক্টরে কাজের সুযোগের অভাব নেই। তবে এখানে যাওয়ার আগে ভিসা, কাজের ধরণ, বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই নিবন্ধে, আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব সৌদি আরবে বিভিন্ন কাজের ধরণ, বেতন কাঠামো, চাহিদাসম্পন্ন পেশাগুলি এবং কাজের সাথে সম্পর্কিত আরও অনেক তথ্য। যারা সৌদি আরবে কাজ করতে আগ্রহী, তাদের জন্য এটি হবে একটি পূর্ণাঙ্গ গাইড।
সৌদি আরবে বাংলাদেশিদের জন্য কাজের সুযোগ
বাংলাদেশ থেকে অনেকেই সৌদি আরবের বিভিন্ন সেক্টরে কাজের সুযোগ গ্রহণ করেন। মূলত নির্মাণ, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, ও গৃহকর্মী হিসেবে প্রচুর বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদি আরবে কাজ করেন। এছাড়া কিছু উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন বাংলাদেশি নাগরিক যেমন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট এবং ম্যানেজার পদেও নিয়োগ পেয়ে থাকেন।
যারা কাজের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, তাদের জন্য প্রাথমিকভাবে কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি:
- বিশ্বস্ত এজেন্সি বা দালালের মাধ্যমে যোগাযোগ: অনেকেই ভুল তথ্য বা প্রতারণার শিকার হন অযোগ্য দালাল বা এজেন্সির কারণে। তাই সবসময় বিশ্বস্ত এবং সরকারি অনুমোদিত এজেন্সি থেকে ভিসা ও অন্যান্য কার্যাদি সম্পন্ন করা উচিত।
- ভিসা সংক্রান্ত সচেতনতা: ভিসার ধরণ অনুযায়ী কাজের ধরন নির্ধারিত হয়। কনস্ট্রাকশন, ড্রাইভিং, রেস্টুরেন্ট, বা অফিস স্টাফ ভিসার আলাদা আলাদা নিয়ম রয়েছে, তাই কোন ভিসা নিয়ে যেতে চান তা আগে নিশ্চিত করে নিন।
সৌদি আরবে কোন কাজের বেতন বেশি
সৌদি আরবে বিভিন্ন ধরণের কাজের জন্য বেতনের হার ভিন্ন। কিছু বিশেষায়িত পেশার জন্য বেতন অপেক্ষাকৃত বেশি এবং এর চাহিদাও বেশি। নিচে সৌদি আরবে উচ্চ বেতনের কয়েকটি পেশা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
সৌদি আরবে নির্মাণ শিল্পে প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছে। ফলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা রয়েছে। এ পেশায় যারা দক্ষ, তারা মাসিক বেতন হিসেবে ৫,০০০ থেকে ৭,০০০ সৌদি রিয়াল পর্যন্ত (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১.২ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ টাকা) আয় করতে পারেন।
২. মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদেরও সৌদি আরবে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তারা নির্মাণ, কারখানা এবং অন্যান্য খাতেও কাজ করেন। এ পেশায় কাজ করা ব্যক্তিরা মাসিক ৫,০০০ থেকে ৮,০০০ সৌদি রিয়াল পর্যন্ত আয় করতে পারেন, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১.৫ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ টাকা।
৩. চিকিৎসক ও নার্স
চিকিৎসক এবং নার্সদের বেতন অন্যান্য পেশার তুলনায় অনেক বেশি। কারণ, এই পেশায় উচ্চ শিক্ষা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। একজন চিকিৎসক মাসিক ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ সৌদি রিয়াল (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২.৫ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ টাকা) পর্যন্ত বেতন পান। নার্সদের বেতন কিছুটা কম হলেও তবুও এটি অন্যান্য পেশার তুলনায় বেশ ভালো।
৪. ফার্মাসিস্ট
সৌদি আরবে ফার্মাসিস্টদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশি ফার্মাসিস্টদের জন্য এই পেশা একটি ভালো সুযোগ হতে পারে। মাসিক বেতন ৪,০০০ থেকে ৬,০০০ সৌদি রিয়াল পর্যন্ত হতে পারে।
৫. হিসাবরক্ষক ও হিসাব সহকারী
সৌদি আরবে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও হিসাবের কাজের জন্য দক্ষ কর্মীর চাহিদা বেশি। হিসাবরক্ষক এবং হিসাব সহকারী হিসেবে যারা কাজ করেন, তারা মাসিক ৩,৫০০ থেকে ৫,৫০০ সৌদি রিয়াল পর্যন্ত আয় করতে পারেন।
৬. ড্রাইভিং
ড্রাইভিং পেশায় সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেক চাহিদা রয়েছে। এটি একটি সম্মানজনক পেশা এবং ড্রাইভাররা মাসিক গড়ে ২,৫০০ থেকে ৩,৫০০ রিয়াল পর্যন্ত বেতন পেতে পারেন।
২০২৪ সালে সৌদি আরবে বিভিন্ন পেশার বেতন কেমন
প্রতি বছর বেতন কাঠামোতে পরিবর্তন আসে এবং ২০২৪ সালে সৌদি আরবে বিভিন্ন পেশার জন্য বেতন আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য গড়ে নিম্নে দেওয়া বেতন কাঠামো প্রযোজ্য হতে পারে:
- সাধারণ শ্রমিক: ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ টাকা (প্রায় ৮০০ থেকে ১,০০০ সৌদি রিয়াল)
- কারিগরি শ্রমিক (যেমন: ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, এসি মেকানিক): ৫০,০০০ থেকে ৭০,০০০ টাকা (প্রায় ১,২০০ থেকে ১,৫০০ সৌদি রিয়াল)
- ড্রাইভার ও সেলসম্যান: ৬০,০০০ থেকে ৮০,০০০ টাকা (প্রায় ১,৫০০ থেকে ২,০০০ সৌদি রিয়াল)
- রেস্টুরেন্ট স্টাফ (ওয়েটার, কুক, ক্লিনার): ৫০,০০০ থেকে ৬০,০০০ টাকা (প্রায় ১,২০০ থেকে ১,৫০০ সৌদি রিয়াল)
- ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা: ১.৫ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ টাকা (৩,৫০০ থেকে ২০,০০০ সৌদি রিয়াল পর্যন্ত)
কোন কোন পেশায় ২০২৪ সালে সৌদি আরবে বেশি চাহিদা
বর্তমানে সৌদি আরবে কিছু নির্দিষ্ট পেশার চাহিদা অনেক বেশি। এই পেশাগুলির মধ্যে রয়েছে:
- ইলেকট্রিশিয়ান এবং প্লাম্বার: নির্মাণ এবং মেরামত কাজে দক্ষ ইলেকট্রিশিয়ান এবং প্লাম্বারদের চাহিদা খুব বেশি। বিশেষ করে নতুন প্রকল্পগুলোতে তাদের কাজের প্রয়োজনীয়তা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- অটোমোবাইল টেকনিশিয়ান: গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষ অটোমোবাইল টেকনিশিয়ানদের চাহিদা বেড়েছে।
- ডেলিভারি ম্যান এবং সেলসম্যান: অনলাইন কেনাকাটা এবং হোম ডেলিভারির প্রচলন বৃদ্ধি পাওয়ায় ডেলিভারি ম্যানের চাহিদা বেড়েছে।
- ফ্যাক্টরি শ্রমিক: বিভিন্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানেও ফ্যাক্টরি শ্রমিকদের প্রয়োজন রয়েছে।
- গৃহকর্মী: সৌদি আরবে অনেক বাংলাদেশি গৃহকর্মী হিসেবেও কাজ করেন। গৃহকর্মীর কাজের জন্য মাসিক ১,০০০ থেকে ১,৫০০ রিয়াল বেতন দেওয়া হয়ে থাকে।
সৌদি আরবে সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ বেতন কত
সৌদি আরবে বিভিন্ন পেশার উপর নির্ভর করে বেতন কাঠামো ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সর্বনিম্ন বেতন সাধারণত ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ টাকা (৮০০ থেকে ১,০০০ রিয়াল) এবং সর্বোচ্চ বেতন ২ লক্ষ থেকে আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
সর্বনিম্ন বেতন:
সাধারণ শ্রমিকদের জন্য ৮০০ থেকে ১,৫০০ রিয়াল পর্যন্ত বেতন দেয়া হয়।
সর্বোচ্চ বেতন:
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা বিশেষজ্ঞদের জন্য সর্বোচ্চ বেতন ২ লক্ষ থেকে আড়াই লক্ষ টাকা হতে পারে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ রিয়াল পর্যন্ত হতে পারে।
সৌদি আরবে উচ্চ বেতনের পেশার তালিকা
১. ডাক্তার ২. ইঞ্জিনিয়ার (যেমন: সিভিল, মেকানিক্যাল) ৩. ফার্মাসিস্ট ৪. অফিস ম্যানেজার ৫. হিসাবরক্ষক ৬. এক্সিকিউটিভ সহকারি ৭. আইটি বিশেষজ্ঞ
শেষ কথা
সৌদি আরব বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য অন্যতম বৃহত্তম কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। এখানে কাজের পাশাপাশি জীবনযাপনের সুযোগও ভালো। তবে সৌদি আরবে যেতে ইচ্ছুকদের জন্য কিছু পরামর্শ:
- বিশ্বস্ত এজেন্সির মাধ্যমে ভিসা গ্রহণ করুন।
- ভিসার ধরন ও কাজের শর্তাবলী সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিন।
- কাজের বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে নিশ্চিত হন।
সৌদি আরবে কাজ করতে যাওয়ার আগে এ সমস্ত তথ্য মাথায় রাখলে প্রতারণা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। আশা করি, এই নিবন্ধটি সৌদি আরবে কাজের সুযোগ এবং বেতন সংক্রান্ত একটি স্পষ্ট ধারণা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে।