বাংলাদেশে ইন্টারনেট এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং প্রতিদিনের প্রয়োজনীয়তা। বাসা, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সবখানেই ইন্টারনেট ব্যবহারের গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। এ কারণে নিরবচ্ছিন্ন, স্থিতিশীল এবং দ্রুতগতির সংযোগ নিশ্চিত করতে রাউটার হয়ে উঠেছে অপরিহার্য একটি ডিভাইস।
আজকের এই বিশদ আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করবো—রাউটার কেনার আগে কী কী বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, বিভিন্ন বাজেটের রাউটারগুলোর মূল্য, ফিচার এবং ব্যবহারকারীর প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক রাউটার নির্বাচনের টিপস। পাশাপাশি বাংলাদেশে বর্তমানে জনপ্রিয় রাউটার মডেলগুলোর মূল্যতালিকাও তুলে ধরা হবে।
রাউটার কেনার আগে যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে
১. রাউটারের ধরন (Wired বনাম Wireless Router)
- তারযুক্ত রাউটার (Wired Router): কেবল ব্যবহার করে কম্পিউটার বা ডিভাইসে ইন্টারনেট সরবরাহ করে। গতি ও স্থিতিশীলতার দিক থেকে এটি সেরা, তবে মোবাইল ডিভাইস ব্যবহারের জন্য সীমাবদ্ধ।
 - ওয়্যারলেস রাউটার (Wi-Fi Router): ক্যাবল ছাড়াই একাধিক ডিভাইসে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। অধিকাংশ আধুনিক রাউটার ডুয়াল ব্যান্ড (২.৪GHz + ৫GHz) সমর্থন করে, যা গতি ও রেঞ্জে ভিন্নতা আনে।
 - পোর্টেবল রাউটার: ছোট আকারের, ব্যাটারি চালিত এবং অনেক সময় ৩জি/৪জি সিম স্লট থাকে। ভ্রমণকারীদের জন্য এটি উপযোগী।
 
২. রাউটারের রেঞ্জ
- তারযুক্ত রাউটারের কভারেজ প্রায় ৩০০ মিটার।
 - ওয়াই-ফাই রাউটার উন্মুক্ত স্থানে প্রায় ৩০০ ফুট, আর ঘরের ভেতরে প্রায় ১৫০ ফুট পর্যন্ত সিগন্যাল দিতে পারে।
 
৩. ইন্টারনেট স্পিড
- সাধারণ হোম রাউটার: ১৫০ Mbps – ৩০০ Mbps
 - গিগাবিট রাউটার: ১ Gbps পর্যন্ত গতি
 - আধুনিক Wi-Fi 6 রাউটার: আরও উন্নত গতি ও স্থিতিশীল সংযোগ নিশ্চিত করে।
 
৪. গেমিং পারফরম্যান্স
- অনলাইন গেমিংয়ের জন্য প্রয়োজন কম লেটেন্সি এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া।
 - গেমারদের জন্য তারযুক্ত রাউটার বা উচ্চমানের গেমিং রাউটার উত্তম।
 
৫. অ্যান্টেনার সংখ্যা
- একাধিক অ্যান্টেনা থাকলে সিগন্যাল কভারেজ ও স্থিতিশীলতা বাড়ে।
 - বাংলাদেশের বাজারে ১ থেকে ৮ অ্যান্টেনার রাউটার পাওয়া যায়।
 
৬. কানেকশন ক্ষমতা
- তারযুক্ত রাউটার নির্দিষ্ট পোর্ট অনুযায়ী সংযোগ দেয়।
 - ওয়াই-ফাই রাউটার সাধারণত প্রতি ব্যান্ডে ৩২টি ডিভাইস সমর্থন করে। ডুয়াল ব্যান্ড রাউটার প্রায় ৬৪টি ডিভাইস সংযোগ দিতে সক্ষম।
 
৭. স্ট্যান্ডার্ড সাপোর্ট
- সর্বশেষ 802.11ac / Wi-Fi 5 বা 802.11ax / Wi-Fi 6 সমর্থন করে কিনা খেয়াল রাখুন।
 - একাধিক রাউটার ব্যবহার করলে স্ট্যান্ডার্ড সাপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ।
 
৮. ব্যান্ডউইডথ শেয়ারিং
- কিছু রাউটারে প্রতিটি ডিভাইসের জন্য আলাদা ব্যান্ডউইডথ নির্ধারণ করা যায়।
 - এতে একাধিক ব্যবহারকারী একসাথে ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও গতি স্থিতিশীল থাকে।
 
৯. প্যারেন্টাল কন্ট্রোল
- পরিবারে ছোট বাচ্চাদের জন্য অপ্রয়োজনীয় ওয়েবসাইট ব্লক করার সুবিধা।
 - অভিভাবকরা নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবেন।
 
বাংলাদেশে রাউটারের দাম
বাংলাদেশে রাউটারের দাম নির্ভর করে—ব্র্যান্ড, অ্যান্টেনা সংখ্যা, স্পিড ক্ষমতা, স্ট্যান্ডার্ড, গেমিং ফিচার ইত্যাদির উপর।
- বেসিক রাউটার: ১,০০০ টাকা থেকে শুরু
 - মিড-রেঞ্জ রাউটার: ১,৫০০ – ৩,০০০ টাকা
 - অ্যাডভান্স রাউটার: ৩,০০০ – ৫,০০০ টাকা
 - লোড-ব্যালেন্সিং রাউটার: ১০,০০০ টাকার মধ্যে
 - হাই-এন্ড গেমিং ও Wi-Fi 6 রাউটার: ৫,০০০ টাকা থেকে শুরু
 
বাজেটভিত্তিক রাউটার
১. ১,০০০ টাকার নিচে রাউটার
- সাধারণত সিঙ্গেল বা ডাবল অ্যান্টেনা
 - ছোট বাসা (১-২ রুম) এর জন্য উপযোগী
 - বেসিক ইন্টারনেট শেয়ারিং
 
২. ২,০০০ টাকার নিচে রাউটার
- ২-৪ অ্যান্টেনা, ভালো কভারেজ
 - ছোট থেকে মাঝারি আকারের বাড়ি বা অফিসে ব্যবহারযোগ্য
 - অতিরিক্ত সুবিধা: গেস্ট নেটওয়ার্ক, প্যারেন্টাল কন্ট্রোল
 
৩. ৩,০০০ টাকার নিচে রাউটার
- উন্নত ফিচারসহ রাউটার
 - VPN, Firewall, Beamforming সাপোর্ট
 - মাঝারি আকারের বাড়ি বা কর্পোরেট অফিসের জন্য উপযোগী
 
৪. ৪,০০০ টাকার নিচে রাউটার
- উন্নত সিগন্যাল শক্তি, বহু অ্যান্টেনা
 - QoS (Quality of Service) সেটিংস সমর্থন
 - বড় বাড়ি, অফিস বা ব্যবসার জন্য আদর্শ
 
৫. ৫,০০০ টাকার নিচে রাউটার
- Wi-Fi 6 সাপোর্টেড রাউটার
 - হাই-স্পিড ইন্টারনেট, স্ট্রিমিং, গেমিং এবং বড় ব্যবসার জন্য ব্যবহারযোগ্য
 - উন্নত ম্যানেজমেন্ট অপশন ও একাধিক ব্যান্ড
 
ডুয়াল ব্যান্ড রাউটার কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ডুয়াল ব্যান্ড রাউটার একই সাথে ২.৪GHz এবং ৫GHz ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করতে পারে।
- ২.৪GHz ব্যান্ড: দূরে থাকা ডিভাইসের জন্য ভালো
 - ৫GHz ব্যান্ড: কাছাকাছি ডিভাইসের জন্য দ্রুত গতি
 
৫জি রাউটারের সুবিধা
- স্পিড: প্রায় ১৩০০ Mbps পর্যন্ত
 - কম নেটওয়ার্ক কনজেশন
 - খুব কম ল্যাটেন্সি (গেমিং ও ভিডিও কলে উপযোগী)
 - একসাথে বহু ডিভাইস স্থিতিশীল সংযোগ পায়
 - Beamforming ও MIMO প্রযুক্তি যুক্ত থাকে
 
গেমারদের জন্য সেরা রাউটার
- গেমিংয়ে লেটেন্সি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
 - Wired Router সর্বোত্তম।
 - বাজেটবান্ধব গেমিং রাউটার বাংলাদেশে সহজেই পাওয়া যায়।
 
হোম ইউজারদের জন্য রাউটার
- ২ অ্যান্টেনা বিশিষ্ট রাউটার সবচেয়ে জনপ্রিয়।
 - সাধারণত ১০ জন ব্যবহারকারী সহজে ব্যবহার করতে পারে।
 - প্রয়োজন অনুসারে বেশি অ্যান্টেনা বিশিষ্ট রাউটার বেছে নেয়া উচিত।
 
লোড ব্যালেন্সিং রাউটার
- একাধিক ইন্টারনেট লাইন একসাথে সংযুক্ত করে।
 - এক লাইন ডাউন হলে অন্য লাইন ব্যাকআপ দেয়।
 - কর্পোরেট অফিস বা ডাটা সেন্টারের জন্য অপরিহার্য।
 
২০০০ টাকার মধ্যে জনপ্রিয় রাউটার
- TP-Link TL-WR840N
 - Xiaomi Mi 4C
 - D-Link DIR-615
 - Mercusys MW325R
(সর্বোচ্চ ৩০০ Mbps স্পিড, ২-৪ অ্যান্টেনা, ছোট থেকে মাঝারি আকারের বাড়ি/অফিসের জন্য আদর্শ) 
রাউটারের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর ৭ টিপস
- সর্বশেষ ফার্মওয়্যার আপডেট করুন
 - রাউটারকে কেন্দ্রীয় স্থানে রাখুন
 - সিগন্যাল সমস্যা হলে চ্যানেল পরিবর্তন করুন
 - WPA-2 এনক্রিপশন ব্যবহার করুন
 - অতিরিক্ত ডিভাইস সংযোগ এড়িয়ে চলুন
 - গেমিংয়ের জন্য ওয়্যার্ড কানেকশন ব্যবহার করুন
 - পুরনো হলে নতুন রাউটার কিনুন
 
একাধিক অ্যান্টেনাযুক্ত রাউটারের সুবিধা
- শক্তিশালী সিগন্যাল
 - বিস্তৃত কভারেজ
 - দ্রুত ডেটা ট্রান্সফার
 - সিগন্যাল লস কমায়
 - একসাথে বহু ডিভাইস সংযোগ
 
বাংলাদেশের জনপ্রিয় রাউটার মডেল ও দাম (সেপ্টেম্বর ২০২৫)
| রাউটার মডেল | দাম (৳) | 
|---|---|
| Tenda F3 Easy Setup Wi-Fi Router | ১,২২০ | 
| TP-Link Archer C54 AC1200 Beamforming Wi-Fi Router | ১,৯০০ | 
| Tenda AC5 AC1200 Dual Band Smart WiFi Router | ১,৯২০ | 
| TP-Link Archer C6 AC1200 Mesh Wi-Fi Gigabit Router | ৩,০৪৫ | 
| Netis NC21 AC1200 Wireless Fast Gaming Router | ২,০৫০ | 
| Netis WF2409E 300Mbps 3-Antenna Wireless N Router | ১,৪৩০ | 
| TP-Link Archer C64 AC1200 Full Gigabit Wi-Fi Router | ২,৭৯০ | 
| TP-Link Archer C20 AC750 Dual Band WiFi Router | ২,২০০ | 
| TP-Link Archer AX1500 Next-Gen Wi-Fi 6 Router | ৩,৬৭০ | 
| Cudy WR1200 AC1200 Dual Band Smart Wi-Fi Router | ১,৯৫০ | 
শেষ কথা
বাংলাদেশে রাউটার কেনা এখন আর জটিল নয়। বাজারে ১,০০০ টাকা থেকে শুরু করে উন্নতমানের ৫,০০০ টাকার বেশি মূল্যের রাউটার পাওয়া যায়। কারো যদি ছোট বাসার জন্য বেসিক ইন্টারনেট শেয়ারিং দরকার হয় তবে সিঙ্গেল/ডুয়াল অ্যান্টেনা রাউটার যথেষ্ট। অন্যদিকে, অফিস, গেমিং বা উচ্চ ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হবে ডুয়াল ব্যান্ড, গিগাবিট বা Wi-Fi 6 রাউটার।
সঠিক প্রয়োজন ও বাজেট অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিলে—একটি ভালো রাউটার আপনার ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতাকে করবে আরো দ্রুত, স্থিতিশীল এবং ঝামেলাহীন।



