বিশ্বের নানা প্রান্তে মসলাকে কেন্দ্র করে গ২ড়ে উঠেছে সভ্যতার ইতিহাস, বাণিজ্য, এমনকি সাম্রাজ্যও। মসলার মধ্যে কিছু সাধারণ হলেও, কিছু এতই বিরল ও মূল্যবান যে তাকে কেবল ধনীদের হাতের নাগালেই ধরা যায়। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে জাফরান (Saffron), যা পৃথিবীব্যাপী ‘লাল স্বর্ণ’ নামে সুপরিচিত। বেগুনি রঙের এক বিশেষ ফুল ক্রোকাস স্যাটিভাস (Crocus sativus) এর লাল গর্ভমুণ্ড শুকিয়ে তৈরি হয় এই অপূর্ব মসলা।
প্রতি বছর মাত্র একবার সংগ্রহযোগ্য এই মসলাটি পেতে ১ লক্ষ ৫০ হাজারেরও বেশি ফুল প্রয়োজন হয়। এত কষ্টসাধ্য সংগ্রহপ্রক্রিয়া ও স্বল্প উৎপাদনের কারণেই এটি পৃথিবীর সবচেয়ে দামী মসলার খেতাব অর্জন করেছে। একদিকে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব, অন্যদিকে বর্তমান বাজারে এর বিস্ময়কর মূল্য—সব মিলিয়ে জাফরান আজও রহস্য, ঐশ্বর্য এবং বিলাসিতার প্রতীক।
জাফরানের উৎপত্তি ও পরিচিতি
জাফরান আসে ক্রোকাস স্যাটিভাস নামক উদ্ভিদ থেকে, যা লিলি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। হাজার বছরের ইতিহাসে মসলাটির বিভিন্ন আঞ্চলিক নাম প্রচলিত হয়েছে: কেশর, কুমকুম, সাফরান, ইসপাগনল ইত্যাদি।
- ধারণা করা হয় গ্রিসেই প্রথম জাফরানের উৎপত্তি।
- তবে বর্তমানে ইরান, স্পেন, ভারতের কাশ্মীর, গ্রিস, মরক্কো প্রভৃতি দেশেই এর মূল চাষাবাদ হয়ে থাকে।
- একটি ফুল থেকে গড়ে ৩০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত গর্ভমুণ্ড সংগ্রহ করা সম্ভব, শুকানোর পর যা দাঁড়ায় প্রায় ৭ মিলিগ্রামে।
- এক কেজি শুকনো জাফরান সংগ্রহে প্রয়োজন হয় প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার ফুল।
এই কঠিন বাস্তবতাই জাফরানকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মসলার শীর্ষে রেখেছে।
ইতিহাসের পাতায় জাফরানের যাত্রা
প্রাগৈতিহাসিক ব্যবহার
৫০ হাজার বছর পূর্বে বর্তমান ইরাক অঞ্চলের গুহাচিত্রে বন্য জাফরানের চিহ্ন পাওয়া যায়। এটি প্রমাণ করে যে মানুষ তখনও জাফরানকে রঙ তৈরিতে ব্যবহার করত।
প্রাচীন সভ্যতায় ব্যবহার
- সুমেরীয়, অ্যাসিরিয়ান ও ব্যাবিলনীয়রা জাফরানকে ঔষধি ও আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহার করত।
- মিশরীয় সভ্যতাতে এটি প্রসাধনী, সুগন্ধি এবং রাজকীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হত।
- গ্রিক মিনোয়ান সভ্যতার সান্তোরিনি দ্বীপে আবিষ্কৃত বিখ্যাত ফ্রেস্কো “দ্য স্যাফরন গাদারার্স” (১৬০০ খ্রিস্টপূর্ব) জাফরানের গুরুত্ব প্রমাণ করে।
মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ
মধ্যযুগে জাফরান ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং রন্ধনশৈলীতে স্থান পায়। বর্তমানে এটি বিশ্বের নানা প্রান্তে বিরিয়ানি, পোলাও, মিষ্টি, শরবত, স্যুপ, এমনকি প্রসাধনী ও ঔষধ শিল্পেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
জাফরানের বাজারমূল্য বৈশ্বিক ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
বিশ্ববাজারে জাফরান
- ২০২৪ সালের শেষ দিকে প্রতি কেজি জাফরানের দাম ছিল ৩,০০,০০০ – ৪,০০,০০০ টাকা।
- ২০২৫ সালে দাম আরও বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি কেজি দাঁড়াতে পারে ৪,০০,০০০ – ৫,০০,০০০ টাকা।
- ইরান বৈশ্বিক উৎপাদনের প্রায় ৯০% সরবরাহ করে থাকে।
বাংলাদেশের বাজারে জাফরান
- ২০২৪ সালের শেষের দিকে প্রতি গ্রাম দাম ছিল ২০০ – ৩০০ টাকা।
- ২০২৫ সালে দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৫০ – ৩৫০ টাকা প্রতি গ্রাম।
- ঢাকা শহরের কারওয়ান বাজার, মৌলভীবাজার, গুলশান-১ এর ডিএনসিসি মার্কেটে এটি বিক্রি হয়।
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি দুবাই হয়ে চোরাইপথে দেশে আসে। বৈধ আমদানি না থাকায় বাজারে প্রকৃত মূল্যমান ও মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত হয় না।
জাফরানের গ্রেডিং ও মান নির্ধারণ
জাফরানের মান অনুসারে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন গ্রেডে ভাগ করা হয়:
- অল রেড সুপার নেগিন – সবচেয়ে উন্নত মান, দীর্ঘ ও পূর্ণাঙ্গ গর্ভমুণ্ড।
- অল রেড নেগিন – মানসম্মত কিন্তু কিছুটা ছোট গর্ভমুণ্ড।
- অল রেড সারগল – মান মাঝারি, তবে বাজারে চাহিদা বেশি।
- ফিলামেন্টস গ্রেড-১ – কিছু লাল ও সামান্য হলুদ অংশ মিশ্রিত।
- ফিলামেন্টস গ্রেড-২ – লাল-হলুদ মিশ্রণ বেশি থাকে; বাংলাদেশে এ ধরণের জাফরান বেশি পাওয়া যায়।
গ্রেড যত উন্নত, দাম তত বেশি।
জাফরান ও গর্ভকালীন স্বাস্থ্য মিথ না বাস্তবতা?
অনলাইনে প্রচলিত রয়েছে—গর্ভাবস্থায় জাফরান খেলে শিশুর গায়ের রঙ ফর্সা হয়। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর কোনো প্রমাণ নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে:
- জাফরান কেবল সুগন্ধি ও রঙ হিসেবে কার্যকর।
- গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসুরক্ষার সাথে এর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।
- ডা. ছাবিকুন নাহার (শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট) স্পষ্টভাবে বলেছেন, এটি নিছক মিথ।
তবে পরিমিত জাফরান স্বাস্থ্যকর হতে পারে, কিন্তু অযথা বিশ্বাসে অতিরিক্ত গ্রহণ ঝুঁকিপূর্ণ।
জাফরানের স্বাস্থ্য উপকারিতা
প্রাচীনকাল থেকে জাফরানকে প্রাকৃতিক ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আধুনিক গবেষণায়ও এর বহু গুণ প্রমাণিত হয়েছে।
সম্ভাব্য উপকারিতা
- ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক – এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে।
- হজমে সহায়ক – পেটের সমস্যা, গ্যাস্ট্রিক ও আলসার নিরাময়ে উপকারী।
- মানসিক স্বাস্থ্য – হতাশা, অবসাদ ও মানসিক চাপ কমাতে কার্যকর।
- ঘুমের সমস্যা দূরীকরণ – প্রাকৃতিক ঘুমের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- চোখের স্বাস্থ্য – দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে সহায়ক।
- পেশির শক্তি বৃদ্ধি – দীর্ঘমেয়াদী ক্লান্তি কমাতে সহায়ক।
সতর্কতা
- অতিরিক্ত সেবনে বমি, মাথা ঘোরা এমনকি বিষক্রিয়াও হতে পারে।
- গর্ভবতী নারীদের জন্য বেশি মাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
আসল ও নকল জাফরান চেনার কৌশল
বাংলাদেশের বাজারে নকল জাফরানও প্রচুর। তাই ক্রেতাদের সতর্ক হতে হবে।
- গন্ধ: আসল জাফরানের গন্ধ মিষ্টি ও তীব্র, নকলের গন্ধ প্রায় নেই।
- স্বাদ: আসলটির স্বাদ হালকা তিতকুটে, কিন্তু সুগন্ধি।
- রঙ: পানিতে ভিজালে আসল জাফরান ধীরে ধীরে রঙ ছাড়ে, আর নকল জাফরান দ্রুত রঙ ছেড়ে দেয়।
- ফাইবারের গঠন: আসলটির প্রান্ত ফানেল-আকৃতির, নকল হলে সোজা বা ভাঙা দেখা যায়।
বাংলাদেশে জাফরান চাষের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে জাফরান চাষের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে গবেষণামূলকভাবে।
- মসলা গবেষণা কেন্দ্র জানিয়েছে যে দেশের আবহাওয়া সরাসরি চাষের জন্য অনুকূল নয়।
- তবে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিন হাউজ পদ্ধতিতে সফল পরীক্ষা চালানো হয়েছে।
- নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বছরে একাধিকবার জাফরানের ফলন সম্ভব।
- ভবিষ্যতে প্রযুক্তি ও কৃষি উদ্ভাবন ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে সীমিত আকারে জাফরান উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
শেষ কথা
জাফরান কেবল একটি মসলা নয়, এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, অর্থনীতি ও বিলাসিতার প্রতীক। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক রান্নাঘর—সবখানেই এর উপস্থিতি স্পষ্ট। বাংলাদেশে এর জনপ্রিয়তা বাড়লেও উচ্চ মূল্য, সীমিত সরবরাহ ও নকলের কারণে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে।