এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন কত ২০২৫

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক ও কর্মচারীদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার এমপিও (Monthly Pay Order) নীতিমালা চালু করে। এমপিওভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে শিক্ষক ও কর্মচারীরা সরকারি অংশ থেকে বেতন-ভাতা পান, যা তাদের জীবনের অন্যতম ভরসাস্থল। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করলে এখনও বেসরকারি এমপিওভুক্ত কর্মীদের বেতন কাঠামোতে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়।

এই নিবন্ধে আমরা ২০২৫ সালের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে তুলনা এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও শর্তাবলী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

এমপিও নীতিমালা ২০২১ জনবল কাঠামো ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া

বেসরকারি স্কুল ও কলেজের জন্য ২০২১ সালে প্রণীত জনবল কাঠামো ও এ.পি.ও. নীতিমালা অনুযায়ী এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীরা জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুসারে বেতন পান।

প্রতিমাসে:

  • সরকারি অংশ সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়।
  • প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অংশ যুক্ত হয়ে পূর্ণ বেতন নির্ধারিত হয়।

একজন শিক্ষক বা কর্মচারীর বেতন গঠিত হয় নিম্নরূপভাবে—

  • মূল বেতন (গ্রেডভিত্তিক)
  • বাড়ি ভাড়া ভাতা: ১,০০০ টাকা
  • চিকিৎসা ভাতা: ৫০০ টাকা
  • বিশেষ সুবিধা: ১,৮৭৫ টাকা

মোট বেতন দাঁড়ায় প্রায় ১৫,৭৮৫ টাকা। তবে কল্যাণ অনুদানের জন্য মূল বেতনের ১০% কর্তন হওয়ায় প্রকৃত হাতে পাওয়া অর্থ দাঁড়ায় প্রায় ১৪,৬২৫ টাকা

একজন সহকারী শিক্ষকের প্রারম্ভিক বেতন

একজন নতুনভাবে যোগদানকারী এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষক (নিম্ন মাধ্যমিক/মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক স্তর) প্রাথমিকভাবে পান—

  • মূল বেতন: ১২,৫০০ টাকা
  • বাড়ি ভাড়া ভাতা: ১,০০০ টাকা
  • চিকিৎসা ভাতা: ৫০০ টাকা

মোট প্রারম্ভিক বেতন = ১৪,০০০ টাকা

তবে অভিজ্ঞতা, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণ ডিগ্রির উপর নির্ভর করে এই বেতন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়।

১০ম গ্রেডে পদোন্নতির শর্তাবলী

যে শিক্ষকরা ডিগ্রিবিহীন সহকারী শিক্ষক বা সহকারী মৌলভী হিসেবে যোগ দেন, তাদের জন্য বিশেষ শর্ত রয়েছে।

  • যোগদানের ৫ বছরের মধ্যে সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ অথবা অনুমোদিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড/বিএমএড/সমমান শিক্ষাগত ডিগ্রি অর্জন করতে হবে।
  • এ শর্ত পূরণ করলে শিক্ষক জাতীয় বেতন স্কেলের ১০ম গ্রেডে বেতন-ভাতা পাবেন।
  • তবে এ ডিগ্রির কারণে প্রাপ্ত গ্রেডকে উচ্চতর স্কেল হিসেবে গণ্য করা হবে না।

অর্থাৎ, প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা শিক্ষকদের জন্য দ্রুত বেতন বৃদ্ধি ও গ্রেড উন্নতির সুযোগ রয়েছে।

অফিস সহায়ক ও নিরাপত্তা কর্মীদের বেতন

শুধু শিক্ষক নয়, এমপিও কাঠামোর আওতায় অফিস সহায়ক, নিরাপত্তা কর্মী ও আয়া পদেও বেতন নির্ধারিত হয়েছে।

  • মূল বেতন: ৮,২৫০ টাকা
  • বাড়ি ভাড়া ভাতা: ১,০০০ টাকা
  • চিকিৎসা ভাতা: ৫০০ টাকা

মোট মাসিক বেতন = ৯,৭৫০ টাকা

এছাড়া বছরে দুইবার মূল বেতনের ৫০% উৎসব ভাতা পান।

উৎসব ভাতা শিক্ষক বনাম কর্মচারী

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই উৎসব ভাতা গুরুত্বপূর্ণ একটি আর্থিক সুবিধা।

  • ২০০৪ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী:
    • শিক্ষকরা পান মূল বেতনের ২৫%
    • কর্মচারীরা পান মূল বেতনের ৫০%

তবে সাম্প্রতিক সংশোধন অনুযায়ী শিক্ষকদের উৎসব ভাতা ৫০% এ উন্নীত করা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষকরা কর্মচারীদের সমান হারে উৎসব ভাতা পাচ্ছেন।

বৈশাখী ভাতা বা বাংলা নববর্ষ ভাতা

এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরাও সরকারি কর্মচারীদের মতোই মূল বেতনের ২০% হারে বৈশাখী ভাতা পান।

উদাহরণ:

  • মূল বেতন ৮,২৫০ টাকা হলে → বৈশাখী ভাতা ১,৬৫০ টাকা
  • মূল বেতন ৭১,২০০ টাকা হলে → বৈশাখী ভাতা ১৪,২৪০ টাকা

সহকারী শিক্ষকের যোগ্যতা ও বেতন কাঠামো ২০২৫

১০ম গ্রেড সহকারী শিক্ষক (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত)

  • যোগ্যতা: স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতসহ বিজ্ঞান/ব্যবসা শিক্ষা/মানবিক বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি ও বিএড ডিগ্রি।
  • বয়সসীমা: সর্বোচ্চ ৩৫ বছর (বিশেষ ক্ষেত্রে শিথিলযোগ্য)।
  • মূল বেতন: ১৬,০০০ টাকা
  • জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫: ১৬,০০০ – ৩৮,৬৪০ টাকা

প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক

  • মূল বেতন: ১২,৫০০ টাকা
  • জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫: ১২,৫০০ – ৩০,২৩০ টাকা

সরকারি বনাম এমপিওভুক্ত কর্মচারীদের বেতন ভাতার তুলনা

সুবিধাসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীবেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী
মূল বেতন গ্রেডজাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫
বাড়ি ভাড়া ভাতামূল বেতনের ৪৫%-৬০%নির্ধারিত ১,০০০ টাকা
চিকিৎসা ভাতা১,৫০০ টাকা৫০০ টাকা
বৈশাখী ভাতামূল বেতনের ২০%মূল বেতনের ২০%
উৎসব ভাতামূল বেতনের ১০০%শিক্ষক: ৫০%, কর্মচারী: ৫০%
বার্ষিক ইনক্রিমেন্টগড়ে ৫% বা তার বেশিনির্ধারিত ৫%
পদোন্নতিবিদ্যমানপ্রায় নেই
বদলির সুযোগবিদ্যমাননেই
বিশেষ সুবিধা১৫%১৫%

এই তুলনা থেকে স্পষ্ট যে সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা অনেক সীমিত।

সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ

  1. বাড়ি ভাড়া ভাতা বৈষম্য: সরকারি শিক্ষকরা মূল বেতনের ৪৫%-৬০% পান, অথচ বেসরকারি শিক্ষকরা নির্দিষ্ট মাত্র ১,০০০ টাকা পান।
  2. চিকিৎসা ভাতা বৈষম্য: সরকারি শিক্ষক ১,৫০০ টাকা, বেসরকারি শিক্ষক মাত্র ৫০০ টাকা পান।
  3. পদোন্নতির অভাব: সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পদোন্নতি রয়েছে, কিন্তু এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রায় নেই বললেই চলে।
  4. উৎসব ভাতার পার্থক্য: সরকারি শিক্ষকরা পূর্ণ মূল বেতন পান, অথচ বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য তা অর্ধেক।

সমাধানের প্রস্তাবনা

  • এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া ভাতা সরকারি শিক্ষকদের সমান করার দাবি তোলা হয়েছে।
  • চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি করে ন্যূনতম ১,৫০০ টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে।
  • উৎসব ভাতা ১০০% করার দাবি দীর্ঘদিন ধরে চলছে।
  • পদোন্নতি ব্যবস্থা ও বদলির সুযোগ চালু করা হলে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নতি সম্ভব হবে।

শেষ কথা

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি বড় অংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নির্ভরশীল। অথচ এই খাতের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা এখনও সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় অনেক কম সুবিধা পাচ্ছেন ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top