বাংলাদেশের অনেক তরুণ-তরুণী, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণপ্রেমীরা ইউরোপের উন্নত জীবনযাত্রা ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার জন্য ইতালিকে স্বপ্নের দেশ হিসেবে মনে করেন। শুধু চাকরি বা ব্যবসা নয়, বরং বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি উপভোগ করার জন্যও ইতালি বাংলাদেশিদের কাছে আকর্ষণীয়।
তবে এই ইউরোপীয় দেশে যেতে হলে প্রথমেই জানতে হবে – বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে কত টাকা লাগে?, কী কী কাগজপত্র দরকার হয়, ভিসার ধরনগুলো কী, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বৈধভাবে যাওয়ার সহজ উপায়গুলো কী। এই আর্টিকেলে আমরা সেসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
কেন ইতালি বাংলাদেশিদের কাছে এত জনপ্রিয়?
বাংলাদেশ থেকে ইতালিকে আকর্ষণীয় মনে করার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে –
- অর্থনৈতিক সুযোগ: ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ইতালিতে কাজের সুযোগ এবং ন্যূনতম বেতন বেশি।
- উচ্চশিক্ষা: ইতালির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে রয়েছে এবং স্কলারশিপের সুযোগও তুলনামূলক বেশি।
- ভ্রমণ ও সংস্কৃতি: ঐতিহাসিক স্থাপনা, শিল্পকলা, এবং আধুনিক জীবনধারার জন্য ইতালি অন্যতম।
- অভিবাসী কমিউনিটি: ইতালিতে আগে থেকেই বড় আকারে বাংলাদেশি কমিউনিটি রয়েছে, ফলে নতুনদের মানিয়ে নেওয়া সহজ হয়।
বাংলাদেশ থেকে ইতালি যাওয়ার বৈধ উপায়
অনেকে দালালের মাধ্যমে বা অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি জমায়। কিন্তু এতে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং জীবনেরও ঝুঁকি থাকে। তাই বৈধ উপায়েই ইতালি যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
১. সরকারি উদ্যোগে যাত্রা
বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ইতালিতে কাজ বা পড়াশোনার সুযোগ করে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ:
- প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়
- বোয়েসেল (BOESL)
- বিএমইটি (BMET)
- ভিএফএস গ্লোবাল (VFS Global)
এসব প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে নিয়মিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
২. সরাসরি ভিসা আবেদন
যে কেউ চাইলে নিজে নিজে ইতালির দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন করতে পারেন। এজন্য অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করে, কাগজপত্র জমা দিতে হয়।
৩. বিশ্বস্ত এজেন্সির মাধ্যমে
অনেকে ঝামেলা এড়াতে রেজিস্টার্ড ও বিশ্বস্ত এজেন্সির মাধ্যমে ভিসা প্রসেস করে থাকেন। তবে দালাল বা প্রতারক এড়িয়ে চলা অত্যন্ত জরুরি।
ইতালি ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
ভিসার ধরন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণভাবে যে ডকুমেন্টগুলো লাগে:
- বৈধ পাসপোর্ট
- সাম্প্রতিক পাসপোর্ট সাইজ ছবি
- জাতীয় পরিচয়পত্র
- ব্যাংক স্টেটমেন্ট (সাম্প্রতিক ৬ মাসের)
- ভাষা দক্ষতার সার্টিফিকেট (IELTS/TOEFL/GRE)
- ভ্রমণের ইতিহাস (পূর্ববর্তী ভিসা থাকলে)
- একাডেমিক সার্টিফিকেট ও ট্রান্সক্রিপ্ট
- বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার অফার লেটার (স্টুডেন্ট ভিসার ক্ষেত্রে)
- রিকমেন্ডেশন লেটার
- কাজের অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট (ওয়ার্ক ভিসার ক্ষেত্রে)
- পুলিশ ভেরিফিকেশন সার্টিফিকেট
- মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট
বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে কত টাকা লাগে?
ইতালি যাওয়ার খরচ নির্ভর করে ভিসার ধরন ও যাত্রার পদ্ধতির ওপর।
১. ইতালি ওয়ার্ক পারমিট ভিসা খরচ (২০২৫)
- খরচ: ৮ লাখ – ১৫ লাখ টাকা
- এতে ভিসা ফি, ডকুমেন্ট প্রসেসিং, এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ যুক্ত থাকে।
২. ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা খরচ
- খরচ: ৪ লাখ – ৫ লাখ টাকা
- টিউশন ফি, ভিসা ফি, মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স এবং ডকুমেন্ট প্রসেস অন্তর্ভুক্ত।
- স্কলারশিপ পেলে এই খরচ আরও কম হতে পারে।
৩. ইতালি টুরিস্ট ভিসা খরচ
- খরচ: ৩ লাখ – ৫ লাখ টাকা
- স্বল্পমেয়াদি ভ্রমণের জন্য প্রয়োজন হয়।
৪. সরকারিভাবে বনাম বেসরকারিভাবে
- সরকারিভাবে গেলে খরচ তুলনামূলক কম হয়।
- এজেন্সি বা দালালের মাধ্যমে গেলে খরচ দ্বিগুণ হতে পারে।
ইতালি যাওয়ার জন্য ভিসার ধর
ইতালি ভিসা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত। সাধারণত বাংলাদেশিদের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভিসাগুলো হলো –
- স্টুডেন্ট ভিসা (Student Visa) – উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য।
- ওয়ার্ক ভিসা (Work Permit Visa) – চাকরির উদ্দেশ্যে।
- টুরিস্ট ভিসা (Tourist Visa) – স্বল্পমেয়াদি ভ্রমণের জন্য।
- বিজনেস ভিসা (Business Visa) – ব্যবসায়িক বৈঠক বা বিনিয়োগের জন্য।
- ফ্যামিলি রিইউনিফিকেশন ভিসা – ইতালিতে বসবাসরত পরিবারের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য।
বাংলাদেশ থেকে ইতালি ভ্রমণ সম্পর্কিত তথ্য
- বাংলাদেশ থেকে ইতালির দূরত্ব: প্রায় ৭,২৯৫ কিলোমিটার
- বিমান ভাড়া: প্রায় ৮০,০০০ টাকা (এয়ারলাইন্স ও মৌসুমভেদে পরিবর্তিত হয়)
- ভ্রমণের সময়: বিমানে প্রায় ১০ ঘণ্টা
- ১ ইউরোর মান (২০২৫): প্রায় ১২৬ টাকা
- ভিসা প্রসেসিং সময়: ১৫–২০ দিন (তবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে বেশি সময় লাগতে পারে)
অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার ঝুঁকি
বাংলাদেশ থেকে অনেকেই লিবিয়া, গ্রিস বা অন্য দেশ হয়ে “গেম” খেলে ইতালিতে প্রবেশ করে। কিন্তু এ পথে –
- প্রাণ হারানোর ঝুঁকি থাকে
- আইনগত জটিলতা দেখা দেয়
- আজীবন ইউরোপ ভিসা নিষিদ্ধ হতে পারে
তাই অবৈধ পথে নয়, বরং বৈধ ভিসা প্রক্রিয়া অনুসরণ করাই সর্বোত্তম।
ইতালি যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে কিছু টিপ
- আগে থেকে গবেষণা করুন – ভিসার নিয়ম, খরচ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করুন।
- ব্যাংক হিসাব ঠিক রাখুন – ব্যাংক স্টেটমেন্ট ভিসা অনুমোদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- ভাষা শিখুন – ইতালিয়ান ভাষা শিখলে চাকরি ও পড়াশোনায় সুবিধা হবে।
- বিশ্বস্ত উৎস বেছে নিন – প্রতারক এজেন্সি এড়িয়ে চলুন।
- সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুসরণ করুন – BOESL বা BMET-এর ওয়েবসাইটে নিয়মিত খোঁজ রাখুন।
শেষ কথা
বাংলাদেশ থেকে ইতালি যাওয়া কঠিন কিছু নয়, তবে সঠিক পথ অনুসরণ করাটা সবচেয়ে জরুরি। খরচের দিক থেকে দেখতে গেলে স্টুডেন্ট ভিসা সবচেয়ে সাশ্রয়ী, আর ওয়ার্ক পারমিট ভিসা তুলনামূলক বেশি ব্যয়বহুল। যারা বৈধভাবে সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে যাচ্ছেন, তাদের খরচ অনেক কম হয়।
ইতালি শুধু স্বপ্ন নয়, বরং সঠিক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে সহজেই অর্জনযোগ্য একটি বাস্তবতা।