কোমর ব্যথা — বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে একটি সাধারণ কিন্তু প্রায়শই অবহেলিত শারীরিক সমস্যা। এটি এমন এক অসুখ যা ধীরে ধীরে দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করে, কাজের দক্ষতা কমিয়ে দেয় এবং মানসিক ভারসাম্যেও প্রভাব ফেলে। অনেক নারীই এই ব্যথাকে বয়সের ফলাফল বা সাময়িক অস্বস্তি ভেবে গুরুত্ব দেন না, কিন্তু বাস্তবে কোমর ব্যথা হতে পারে শরীরের অভ্যন্তরীণ কোনো জটিল অবস্থার ইঙ্গিত।
মহিলাদের কোমর ব্যথার কারণ
কোমর ব্যথার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে, যেগুলি শারীরিক, হরমোনজনিত, মানসিক কিংবা জীবনধারাগত হতে পারে। নিচে এই কারণগুলিকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো।
১. মাসিক চক্রের প্রভাব
মাসিক চক্রের সময় মহিলাদের কোমরে ব্যথা হওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। জরায়ু সংকোচন এবং হরমোনের পরিবর্তনের ফলে এই সময়ে শরীরের নিচের অংশে চাপ সৃষ্টি হয়, যা কোমর ব্যথার কারণ হতে পারে। অনেক মহিলারাই মাসিকের সময় কোমরে ব্যথা অনুভব করেন যা কিছুটা অস্বস্তি সৃষ্টি করে।
২. গর্ভাবস্থার সময় শারীরিক পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায় শরীরের ভারসাম্য, হরমোনের গঠন ও ওজন—সবই পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের ফলেই কোমর ব্যথা দেখা দেয়।
গর্ভাবস্থার রিল্যাক্সিন (Relaxin) নামক হরমোনটি শরীরের লিগামেন্টগুলোকে নরম করে, যাতে প্রসবের সময় জরায়ু ও পেলভিস প্রসারিত হতে পারে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় কোমর ও মেরুদণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে।সঠিক ভঙ্গিতে চলাফেরা, হালকা ব্যায়াম, এবং maternity support belt ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়।
৩. ভুল ভঙ্গি ও পেশীর টান
দীর্ঘ সময় ধরে এক ভঙ্গিতে বসে থাকা বা ভারী কিছু তোলার সময় ভুলভাবে শরীর মোচড়ানো—এই অভ্যাসগুলো কোমরের পেশীতে অতিরিক্ত চাপ ফেলে।
ধীরে ধীরে পেশী শক্ত হয়ে যায়, রক্ত চলাচল কমে যায় এবং ব্যথা স্থায়ী রূপ নিতে পারে।
৪. মেরুদণ্ডের গঠনগত সমস্যা
মেরুদণ্ড আমাদের শরীরের প্রধান ভারবাহী স্তম্ভ। এর গঠন বা ডিস্কে সামান্য পরিবর্তনও কোমর ব্যথার কারণ হতে পারে।এই ধরনের সমস্যাগুলি মেরুদণ্ডের নড়াচড়া বা কার্যকারিতা সীমিত করতে পারে, যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী কোমর ব্যথা সৃষ্টি হয়।
৫. মানসিক চাপ ও সাইকোসোম্যাটিক প্রভাব
মানসিক উদ্বেগ, কাজের চাপ, পারিবারিক অশান্তি—এই মানসিক কারণগুলোও শারীরিক ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।দীর্ঘদিন ধরে চাপ থাকলে পেশী টানটান হয়ে যায়, রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় এবং কোমরে ভারী ভাব অনুভূত হয়।
মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে, অথচ stress management কোমর ব্যথা নিরাময়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৬. অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
অতিরিক্ত ওজন, ধূমপান, অ্যালকোহল গ্রহণ, বা শারীরিক কার্যকলাপের অভাব কোমর ব্যথার ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়।
অতিরিক্ত ওজন শরীরের ভারের কেন্দ্রকে পরিবর্তন করে, ফলে কোমরকে বেশি চাপ নিতে হয়।
একইভাবে ধূমপান রক্তপ্রবাহে বাধা দেয়, যা মেরুদণ্ডের টিস্যুগুলির পুনর্গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
নিয়মিত হাঁটা, সুষম আহার ও পর্যাপ্ত ঘুমই এই অবস্থার প্রতিকার।
৭. অন্যান্য চিকিৎসাজনিত কারণ
কিছু অন্তর্নিহিত রোগও কোমর ব্যথার পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে। কিডনি পাথর, ইউটিআই (মূত্রনালীর সংক্রমণ), এন্ডোমেট্রিওসিস এবং ফাইব্রোমিয়ালজিয়া এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এইসব সমস্যাগুলি কেবল কোমরে ব্যথা সৃষ্টি করে না, বরং পুরো শরীরের উপরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কোমর ব্যথার প্রতিকার
কোমর ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন নিয়মিত যত্ন, সঠিক জীবনধারা এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো ব্যবস্থা গ্রহণ। নিচে ধাপে ধাপে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকারগুলো তুলে ধরা হলো।
১. পর্যাপ্ত বিশ্রাম
তীব্র ব্যথা হলে শরীরকে কিছুদিন বিশ্রাম দেওয়া উচিত, যাতে পেশীগুলো পুনরায় সুস্থ হতে পারে। তবে একদম নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে উল্টো ক্ষতি হয়।
‘Active rest’, অর্থাৎ হালকা নড়াচড়া রেখে বিশ্রাম নেওয়াই সবচেয়ে কার্যকর।
২. নিয়মিত ব্যায়াম
শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং কোমর ব্যথা প্রতিরোধ করতে নিয়মিত ব্যায়াম অত্যন্ত জরুরি। নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের পেশী শক্তিশালী করে এবং নমনীয়তা বৃদ্ধি করে। নিয়মিত ব্যায়াম কোমর ব্যথা প্রতিরোধে এবং এর তীব্রতা কমাতে সাহায্য করতে পারে। বিশেষ করে কোমরের জন্য বিশেষ কিছু ব্যায়াম যেমন প্লাঙ্ক, ব্রিজ ইত্যা
৩. ফিজিওথেরাপি ও পেশাদার থেরাপি
একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্ট কোমর ব্যথার মূল উৎস শনাক্ত করে নির্দিষ্ট থেরাপি নির্ধারণ করতে পারেন।
তাঁরা ব্যায়াম, হট প্যাক, আল্ট্রাসাউন্ড বা ইলেকট্রিক স্টিমুলেশন ব্যবহার করে পেশীর শক্তি ও নমনীয়তা বাড়াতে সাহায্য করেন।
৪. ওজন নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক ভঙ্গি
ওজন নিয়ন্ত্রণ:
সঠিক ওজন বজায় রাখলে কোমরের ওপর চাপ অনেকটাই কমে যায়।
সুষম খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত হাঁটা এই ক্ষেত্রে কার্যকর।
সঠিক ভঙ্গি:
- চেয়ারে বসে পিঠ সোজা রাখুন
- হাঁটার সময় মাথা উঁচু ও কাঁধ শিথিল রাখুন
- ভারী জিনিস তুলতে হাঁটু ভাঁজ করুন, কোমর নয়
একটি ergonomic চেয়ার অফিসে দীর্ঘ সময় বসে কাজ করা নারীদের জন্য বিশেষ উপযোগী।
৫. খাদ্যাভ্যাসে পুষ্টিকর উপাদান সংযোজন
হাড়ের শক্তি নির্ভর করে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন D ও প্রোটিনের ওপর।
তাই খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন—
- দুধ, দই, পনির
- ডিমের কুসুম
- মাছ, বিশেষ করে সার্ডিন ও সালমন
- সবুজ শাকসবজি
অতিরিক্ত চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা ব্যথা বাড়িয়ে দিতে পারে।
৬. মানসিক প্রশান্তি ও স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট
ধ্যান (Meditation), প্রণায়াম, হালকা যোগব্যায়াম ও সঙ্গীত থেরাপি মানসিক চাপ কমাতে অসাধারণ ভূমিকা রাখে।
প্রতিদিন ১০ মিনিট নিঃশব্দে বসে গভীর শ্বাস নেওয়া শরীরের অক্সিজেন প্রবাহ বাড়িয়ে ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
৭. ওষুধ ও চিকিৎসা
প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।
- NSAIDs (যেমন আইবুপ্রোফেন): প্রদাহ কমায়
- Muscle relaxants: পেশী শিথিল করে
- Topical ointment বা হিট ক্রিম: স্থানীয় আরাম দেয়
তবে ওষুধকে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে নয়, সাময়িক উপশম হিসেবে ব্যবহার করা উচিত।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি
কোমর ব্যথা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা নিচের উপসর্গগুলির কোনোটি দেখা দেয়, তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
- ব্যথা তিন সপ্তাহের বেশি স্থায়ী থাকে
- জ্বর, ওজন কমে যাওয়া বা অবসাদ যুক্ত হয়
- কোমরের সাথে পায়ে ঝিনঝিনি, দুর্বলতা বা সংবেদনশক্তি হারানো
- মূত্র বা মলত্যাগের সমস্যার সৃষ্টি
- গর্ভাবস্থায় ব্যথা ক্রমবর্ধমান
এসব লক্ষণ উপেক্ষা করলে জটিল স্নায়ুজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
গর্ভবতী মহিলাদের কোমর ব্যথা
গর্ভাবস্থার শেষার্ধে কোমর ব্যথা স্বাভাবিক হলেও এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সঠিক যত্নে।
করণীয়:
- পাশ ফিরে শোয়া, হাঁটুর মাঝে বালিশ রাখা
- গর্ভাবস্থার উপযোগী সাপোর্ট বেল্ট ব্যবহার
- নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, যেমন প্রি-নাটাল যোগা
- হাই হিল এড়িয়ে আরামদায়ক জুতা পরা
যা এড়াতে হবে:
- দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা
- ভারী বস্তু তোলা
- অযথা শরীর মোচড়ানো
গর্ভাবস্থার প্রতিটি পর্যায়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা উচিত।
বয়স্ক মহিলাদের কোমর ব্যথা
বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়, কার্টিলেজ ক্ষয় হয় এবং মেরুদণ্ডের ডিস্ক দুর্বল হয়ে পড়ে।
ফলে কোমর ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে পারে।
প্রতিরোধে করণীয়:
- প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা
- সূর্যালোক গ্রহণ (ভিটামিন D)
- ক্যালসিয়াম ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
- ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার
হালকা যোগব্যায়াম ও স্ট্রেচিং ব্যথা কমিয়ে মানসিক প্রশান্তিও দেয়।
শেষ কথা
মহিলাদের কোমর ব্যথা কোনো তুচ্ছ বিষয় নয়। এটি হতে পারে শরীরের অভ্যন্তরে ঘটতে থাকা গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক ভঙ্গি, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং মানসিক প্রশান্তিই এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।
একজন সচেতন নারী নিজের শরীরের প্রতিটি পরিবর্তনের প্রতি যত্নবান থাকলে কোমর ব্যথা তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে না।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সময়মতো বিশ্রাম, এবং প্রয়োজনমতো চিকিৎসা — এই তিনটি সূত্রই পারে আপনাকে এক নির্বিঘ্ন, ব্যথামুক্ত ও সক্রিয় জীবন উপহার দিতে।



