পাসপোর্ট করতে কত টাকা লাগে ২০২৫

বাংলাদেশে পাসপোর্ট এখন শুধু একটি ভ্রমণ নথি নয়; বরং এটি নাগরিক পরিচয়ের একটি অপরিহার্য দলিল। চাকরি, উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা কিংবা পর্যটন—যেকোনো আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য বৈধ পাসপোর্ট অপরিহার্য। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার ই-পাসপোর্ট চালু করার মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়াকে সহজ, স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলেছে। ফলে এখন অনলাইনে কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করলেই বাড়তি ঝামেলা ছাড়াই পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব।

এই দীর্ঘ নিবন্ধে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো—বাংলাদেশে পাসপোর্ট তৈরির ফি, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট, অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া, সময়সীমা, এবং গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ যা আপনার পাসপোর্ট আবেদনকে আরও সহজ করে তুলবে।

পাসপোর্ট কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

পাসপোর্ট শুধুমাত্র বিদেশ ভ্রমণের টিকিট নয়, বরং এটি একজন নাগরিকের আন্তর্জাতিক পরিচয়। অনেক সময় এটি জাতীয় পরিচয়পত্রের থেকেও বেশি গুরুত্ব বহন করে, কারণ বিদেশে অবস্থানের সময় একমাত্র বৈধ নথি হিসেবে পাসপোর্টই কাজ করে।

  • চাকরি বা কর্মসংস্থান: বিদেশে কাজ করতে গেলে বৈধ পাসপোর্ট আবশ্যক।
  • শিক্ষা: আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বা ভিসা প্রক্রিয়ায় পাসপোর্ট অপরিহার্য।
  • চিকিৎসা: উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ ভ্রমণের সময় এটি প্রয়োজন হয়।
  • ব্যবসা: আন্তর্জাতিক ব্যবসা, কনফারেন্স, বা সেমিনারে অংশ নিতে হলে পাসপোর্ট ছাড়া কোনো উপায় নেই।
  • পর্যটন: বিদেশ ভ্রমণ ও পর্যটন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যও বৈধ পাসপোর্ট জরুরি।

ই-পাসপোর্ট আধুনিক সেবা ও সুবিধা

বাংলাদেশে বর্তমানে ই-পাসপোর্ট চালু রয়েছে, যা পূর্বের মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (MRP) তুলনায় আরও উন্নত ও নিরাপদ। এতে রয়েছে ইলেকট্রনিক চিপ, যেখানে ধারকের সমস্ত বায়োমেট্রিক ও ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষিত থাকে।

ই-পাসপোর্টের বিশেষ সুবিধাসমূহ

  1. উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা—কোনো ধরনের জালিয়াতি প্রতিরোধ করা সহজ।
  2. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং বেশিরভাগ দেশে দ্রুত প্রবেশাধিকার দেয়।
  3. দীর্ঘ মেয়াদী সুবিধা—৫ বছর বা ১০ বছরের মেয়াদে পাওয়া যায়।
  4. অনলাইন আবেদন ও ট্র্যাকিং সিস্টেমের মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া।

বাংলাদেশে পাসপোর্ট ফি কাঠামো

বাংলাদেশে পাসপোর্টের ফি নির্ভর করে তিনটি বিষয়ে:

  1. মেয়াদ (৫ বছর বা ১০ বছর)
  2. পৃষ্ঠা সংখ্যা (৪৮ বা ৬৪)
  3. সেবা ধরন (রেগুলার, এক্সপ্রেস, সুপার এক্সপ্রেস)

৫ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট ফি

৪৮ পৃষ্ঠা

  • রেগুলার: ৪,০২৫ টাকা
  • এক্সপ্রেস: ৬,৩২৫ টাকা
  • সুপার এক্সপ্রেস: ৮,৬২৫ টাকা

৬৪ পৃষ্ঠা

  • রেগুলার: ৬,৩২৫ টাকা
  • এক্সপ্রেস: ৮,৬২৫ টাকা
  • সুপার এক্সপ্রেস: ১২,০৭৫ টাকা

১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট ফি

৪৮ পৃষ্ঠা

  • রেগুলার: ৫,৭৫০ টাকা
  • এক্সপ্রেস: ৮,০৫০ টাকা
  • সুপার এক্সপ্রেস: ১০,৩৫০ টাকা

৬৪ পৃষ্ঠা

  • রেগুলার: ৮,০৫০ টাকা
  • এক্সপ্রেস: ১০,৩৫০ টাকা
  • সুপার এক্সপ্রেস: ১৩,৮০০ টাকা

আপনার প্রয়োজন ও জরুরিভেদে কোন ক্যাটাগরি নির্বাচন করবেন তা এই ফি তালিকা দেখে সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

পাসপোর্ট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট

পাসপোর্ট আবেদন করার সময় কিছু কাগজপত্র জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। ভুল বা অসম্পূর্ণ নথি জমা দিলে আবেদন বাতিল হতে পারে। তাই নিচের ডকুমেন্টগুলো অবশ্যই প্রস্তুত রাখুন:

  • জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) অথবা জন্ম নিবন্ধন সনদ
  • অনলাইন আবেদন ফর্মের প্রিন্ট কপি
  • ফি পরিশোধের রশিদ (চালান কপি)
  • নাগরিক সনদপত্র বা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের/চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট
  • পেশার প্রমাণপত্র (ছাত্র হলে প্রতিষ্ঠান প্রধানের সার্টিফিকেট, চাকরিজীবী হলে অফিসের প্রমাণপত্র)
  • অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য: পিতা-মাতার NID কার্ডের ফটোকপি

আবেদন প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে অনলাইন গাইড

বাংলাদেশে এখন পাসপোর্ট আবেদনের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ অনলাইনে করা যায়। নিচে ধাপে ধাপে পদ্ধতিটি দেওয়া হলো:

  1. ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন: www.epassport.gov.bd এ যান।
  2. অ্যাকাউন্ট তৈরি করুন: নতুন আবেদনকারী হলে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
  3. আবেদন ফর্ম পূরণ করুন: নাম, ঠিকানা, পেশা, পিতা-মাতার তথ্যসহ সবকিছু সঠিকভাবে দিন।
  4. প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আপলোড করুন।
  5. ফি পরিশোধ করুন: অনলাইনে ব্যাংক/মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
  6. অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করুন: ছবি তোলা ও বায়োমেট্রিক দেওয়ার জন্য তারিখ নির্ধারণ করুন।
  7. পাসপোর্ট অফিসে হাজির হন: নির্ধারিত তারিখে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যান।
  8. পাসপোর্ট সংগ্রহ করুন: সময়সীমা অনুযায়ী অফিস থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।

পাসপোর্ট প্রসেসিং সময়সীমা

বাংলাদেশে পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য সময়সীমা নির্ভর করে আপনি কোন ক্যাটাগরির আবেদন করেছেন তার উপর।

  • রেগুলার: ১৫–২১ কর্মদিবস
  • এক্সপ্রেস: ৭–১০ কর্মদিবস
  • সুপার এক্সপ্রেস: ২–৩ কর্মদিবস

তবে পাসপোর্ট অফিসের কাজের চাপ বা বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সময়সীমা কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে।

সাধারণ ভুল এবং সমাধান

অনেক আবেদনকারী অজান্তে কিছু ভুল করে ফেলেন, যার কারণে আবেদন আটকে যায়।

  • ভুল তথ্য প্রদান: NID-এর সাথে মিল না থাকলে আবেদন বাতিল হয়।
  • অসম্পূর্ণ ডকুমেন্ট: প্রয়োজনীয় নথি না দিলে প্রসেস বন্ধ হয়ে যায়।
  • ফি পরিশোধে বিলম্ব: সময়মতো ফি না দিলে আবেদন গৃহীত হয় না।
  • ফর্ম পূরণে অসতর্কতা: বানান ভুল বা তথ্য গরমিল থাকলে সংশোধনের ঝামেলায় পড়তে হয়।

বিশেষ পরামর্শ

  1. আবেদন ফর্ম পূরণের সময় প্রতিটি তথ্য NID-এর সাথে হুবহু মিলিয়ে লিখুন।
  2. আবেদন জমা দেওয়ার আগে সব ডকুমেন্ট স্ক্যান কপি ও হার্ডকপি প্রস্তুত রাখুন।
  3. জরুরি ভ্রমণের জন্য অবশ্যই সুপার এক্সপ্রেস বেছে নিন।
  4. শিশুদের পাসপোর্ট করতে হলে জন্মসনদ এবং পিতা-মাতার পাসপোর্ট/ভোটার আইডি সাথে রাখুন।
  5. পাসপোর্ট সংগ্রহের সময় ফি রশিদ ও রিসিপ্ট সাথে নিয়ে যান।

শেষ কথা

বাংলাদেশে পাসপোর্ট তৈরি এখন আর জটিল প্রক্রিয়া নয়। অনলাইন আবেদনের সুবিধার কারণে এটি অনেক সহজ হয়ে গেছে। সঠিক ডকুমেন্ট প্রস্তুত রাখা, সময়মতো ফি প্রদান করা, এবং নির্ধারিত ধাপগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করলে অল্প সময়েই আপনি নতুন ই-পাসপোর্ট হাতে পেয়ে যাবেন।

পাসপোর্ট একটি অমূল্য নথি—এটি শুধু আন্তর্জাতিক ভ্রমণের দরজা খুলে দেয় না, বরং এটি আপনার বৈধ পরিচয়ের প্রমাণও বহন করে। তাই সময়মতো পাসপোর্ট তৈরি করুন, সঠিক ক্যাটাগরি বেছে নিন এবং নিজের ভ্রমণ পরিকল্পনাকে আরও সহজতর করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top