বাংলাদেশে বিবাহকে সমাজ ও ধর্ম উভয় ক্ষেত্রেই একটি পবিত্র বন্ধন হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে জীবনের বাস্তব পরিস্থিতি অনেক সময়ে মানুষকে বাধ্য করে সেই বন্ধন ভাঙতে। বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক একটি জটিল, সংবেদনশীল এবং আইনি প্রক্রিয়া, বিশেষত যখন এটি আদালতের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে তালাকের আইনি কাঠামোতে বেশ কিছু হালনাগাদ প্রক্রিয়া ও নিয়ম সংযোজিত হয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব—বাংলাদেশে কোর্টের মাধ্যমে তালাকের আইন, ধাপ, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ভরণপোষণ ও সন্তানের হেফাজত, সম্পত্তি বণ্টন এবং পরবর্তী জীবন-পরিকল্পনা।
বাংলাদেশের আইনি প্রেক্ষাপটে বিবাহ বিচ্ছেদ
বাংলাদেশ একটি বহু-ধর্মীয় দেশ। তাই বিবাহ ও তালাকের ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও পারিবারিক আইন ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রযোজ্য হয়। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য আইন ভিন্ন হলেও, আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের কাঠামো সবার জন্য অভিন্ন।
মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য আইন
- মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১
মুসলিমদের বিবাহ, তালাক, ভরণপোষণ ও পারিবারিক সম্পর্কের আইনি কাঠামো নির্ধারণ করে। - মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন, ১৯৭৪
বিবাহ ও তালাকের যথাযথ নিবন্ধন নিশ্চিত করে।
হিন্দুদের জন্য প্রযোজ্য আইন
- হিন্দু বিবাহ আইন, ১৯৫৫ (ভারতীয় আইনের অনুরূপ কাঠামো)
হিন্দু বিবাহের নানান দিক নির্ধারণ করলেও বাংলাদেশে হিন্দু তালাকের সুস্পষ্ট আইন এখনো সীমিত। তবে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে বিশেষ পরিস্থিতিতে বিচ্ছেদ সম্ভব হয়।
খ্রিস্টানদের জন্য প্রযোজ্য আইন
- ডিভোর্স অ্যাক্ট, ১৮৬৯
খ্রিস্টানদের তালাকের জন্য প্রযোজ্য। এখানে ধর্মীয় ও পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ।
মুসলিম আইনে তালাকের ধরন
বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী তিন ধরনের তালাক প্রচলিত:
- তালাকে বাইন (স্বামীর উদ্যোগে তালাক)
স্বামী নিজের সিদ্ধান্তে তালাক দিতে পারেন, তবে তাকে নির্ধারিত প্রক্রিয়া ও আইনি শর্ত মেনে চলতে হয়। - খুলা (স্ত্রীর আবেদনমূলে তালাক)
স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে তালাক চাইতে পারেন। এজন্য কারণ উল্লেখ ও আদালতের অনুমোদন প্রয়োজন। - মুবারাত (পারস্পরিক সম্মতিতে তালাক)
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এটি অপেক্ষাকৃত সহজ ও সমঝোতামূলক প্রক্রিয়া।
কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার ধাপসমূহ
১. প্রাথমিক পরামর্শ ও সমঝোতা প্রচেষ্টা
- বিবাহ বিচ্ছেদের আগে পারিবারিক সমস্যা সমাধানে মধ্যস্থতা বা কাউন্সেলিং জরুরি।
- আদালত প্রায়শই প্রথম ধাপে উভয় পক্ষকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে নির্দেশ দেয়।
২. আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ
- তালাক একটি জটিল প্রক্রিয়া হওয়ায় একজন দক্ষ ফ্যামিলি ল’য়ার নিয়োগ করা প্রয়োজন।
- তিনি আপনাকে কোর্টে আবেদন, প্রমাণ সংগ্রহ, নোটিশ প্রেরণ ইত্যাদি ধাপ বুঝিয়ে দেবেন।
৩. আবেদন প্রস্তুত ও দাখিল
- পারিবারিক আদালতে তালাকের আবেদনপত্র জমা দিতে হবে।
- এতে উল্লেখ থাকতে হবে:
- বিবাহের তারিখ ও স্থান
- কাবিননামার তথ্য
- সন্তানদের তথ্য (যদি থাকে)
- তালাকের কারণ
- প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের কপি
৪. নোটিশ প্রদান
- আদালত প্রতিপক্ষকে একটি লিখিত নোটিশ পাঠায়।
- প্রতিপক্ষকে নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির হতে হয়।
৫. শুনানি
- শুনানিতে উভয় পক্ষ তাদের প্রমাণ, সাক্ষী এবং যুক্তি উপস্থাপন করে।
- প্রয়োজনে আদালত সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করে।
৬. আদালতের রায়
- প্রমাণ ও সাক্ষ্য যাচাই শেষে আদালত সিদ্ধান্ত দেয় তালাক মঞ্জুর হবে কিনা।
- যদি তালাক মঞ্জুর হয়, তবে আদালত:
- ভরণপোষণ নির্ধারণ
- সন্তানের হেফাজত নির্ধারণ
- সম্পত্তির বণ্টন সম্পর্কিত নির্দেশনা দেয়।
আদালতের মাধ্যমে তালাকের বিশেষ কারণসমূহ
আদালত সাধারণত নিচের কারণে তালাক মঞ্জুর করতে পারে:
- ভরণপোষণ না দেওয়া
- শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন
- অবৈধ সম্পর্ক বা ব্যভিচার
- ধর্মীয় অধিকারের লঙ্ঘন
- দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকা বা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া
তালাকের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
১. বিবাহের সনদপত্র
২. জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি
৩. আবেদনকারী ও প্রতিপক্ষের ছবি
৪. সন্তানের জন্ম সনদপত্র (যদি থাকে)
৫. তালাকের কারণ সম্পর্কিত প্রমাণ
৬. ভরণপোষণের দাবির ক্ষেত্রে আয়ের প্রমাণপত্র
স্বামী ও স্ত্রীর তালাক প্রদানের অধিকার
স্বামী কর্তৃক তালাক
- ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী, স্বামী কারণ ছাড়াই তালাক দিতে পারেন, তবে তাকে আইনি প্রক্রিয়া মেনে চলতে হয়।
স্ত্রী কর্তৃক তালাক
- স্ত্রী সাধারণত সরাসরি তালাক দিতে পারেন না।
- তবে যদি কাবিননামায় তালাক-ই-তৌফিজ ধারা উল্লেখ থাকে, তাহলে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে তালাক নিতে পারেন।
পারস্পরিক সম্মতিতে তালাক
- খুলা বা মুবারাত পদ্ধতিতে উভয় পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে বিচ্ছেদ ঘটে।
- এটি অপেক্ষাকৃত সহজ ও কম সময়সাপেক্ষ।
তালাকের পরবর্তী ধাপসমূহ
১. মোহরানা ও ভরণপোষণ
- তালাকের পর স্বামীকে স্ত্রীকে মোহরানা ও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভরণপোষণ দিতে হয়।
- যদি সন্তান থাকে, তবে তাদের লালন-পালনের জন্যও আর্থিক দায়িত্ব বহন করতে হয়।
২. সন্তানের হেফাজত
- সাধারণত ছোট সন্তানের হেফাজত মা পান।
- তবে সন্তানের স্বার্থ ও নিরাপত্তা বিবেচনা করে আদালত সিদ্ধান্ত নেয়।
৩. সম্পত্তির বণ্টন
- বিবাহ চলাকালীন অর্জিত যৌথ সম্পত্তি আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী বণ্টন হয়।
- সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে অনেক সময় দীর্ঘ আইনি লড়াই হয়।
সমাজ ও মানসিক দিক
তালাক শুধু আইনি নয়, বরং একটি মানসিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ।
- সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের চাপ, আর্থিক অনিশ্চয়তা—সবই একজন মানুষকে ভেঙে দিতে পারে।
- তাই তালাক-পরবর্তী জীবনে মানসিক সহায়তা, পেশাগত দিকনির্দেশনা ও আর্থিক পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি।
শেষ কথা
বাংলাদেশে কোর্টের মাধ্যমে তালাক একটি জটিল কিন্তু প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া। ইসলামে তালাক অনাকাঙ্খিত হলেও ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের স্বার্থে এটি অনুমোদিত হয়েছে। ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে তালাকের আইনি কাঠামো আরো সুসংহত ও প্রক্রিয়াবদ্ধ হয়েছে।