বাংলাদেশে বিদ্যুতের দাম দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সাম্প্রতিক নির্বাহী আদেশে আবারও বিদ্যুতের খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকেই এই নতুন দাম কার্যকর হবে। গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম বেড়েছে প্রায় ৮.৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৭০ পয়সা।
এই সিদ্ধান্ত শুধু বিদ্যুৎ খাতের আর্থিক ভারসাম্যই নয়, বরং দেশের অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা ও সাধারণ ভোক্তাদের জীবনযাত্রায় গভীর প্রভাব ফেলবে। নিচে আমরা বিদ্যুতের নতুন দর, এর প্রভাব, অর্থনৈতিক চাপ, ভর্তুকির কাঠামো এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
বিদ্যুতের নতুন দর কাঠামো বিস্তারিত হিসাব
খুচরা পর্যায়ে নতুন মূল্যহার
- সর্বনিম্ন ব্যবহারকারী (বাসাবাড়ি): প্রতি ইউনিট ২৮ পয়সা বৃদ্ধি।
- সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী (বাসাবাড়ি): প্রতি ইউনিট ১ টাকা ৩৫ পয়সা বৃদ্ধি।
- সেচ খাত: ৪ টাকা ৮২ পয়সা → ৫ টাকা ২৫ পয়সা।
- নিম্নচাপ বাণিজ্যিক/অফিস (২৩০/৪০০ ভোল্ট): ১১ টাকা ৯৩ পয়সা → ১৩ টাকা ১ পয়সা।
- মধ্যম চাপ (১১ কিলোভোল্ট): গড়ে ১১ টাকা ৬৩ পয়সা।
- উচ্চ চাপ শিল্প (৩৩ কিলোভোল্ট): ৯ টাকা ৯০ পয়সা → ১০ টাকা ৭৫ পয়সা।
- অতি উচ্চ চাপ শিল্প (১৩২/২৩০ কিলোভোল্ট): ৯ টাকা ৬৮ পয়সা → ১০ টাকা ৬৬ পয়সা।
- শিক্ষা, ধর্মীয়, হাসপাতাল ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান: ৬ টাকা ৯৭ পয়সা → ৭ টাকা ৫৫ পয়সা।
গড়ে খুচরা বিদ্যুতের দাম দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা, যা আগে ছিল ৮ টাকা ২৫ পয়সা।
পাইকারি পর্যায়ের নতুন হার
- পূর্বে: ৬ টাকা ৭০ পয়সা।
- বর্তমানে: ৭ টাকা ৪ পয়সা।
- গড়ে বৃদ্ধি: ৫%।
বারবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ইতিহাসের আলোকে
গত এক দশকেরও বেশি সময়ে বিদ্যুতের দামের ক্রমাগত বৃদ্ধি ভোক্তাদের জন্য নতুন কিছু নয়।
- ২০০৮–২০২3 সময়ে খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।
- পাইকারি পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে ১২ বার।
- সর্বশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন দফায় মাসে মাসে গড়ে ৫% বৃদ্ধি হয়েছিল।
- একই বছরে পাইকারি পর্যায়ে ৮% মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল।
অতএব, প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এক ধরনের নিয়মিত প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে।
ভর্তুকির বোঝা ও পিডিবির লোকসান
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে ছয়টি বিতরণ সংস্থার কাছে সরবরাহ করে। কিন্তু উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ফারাক থাকায় প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত লোকসানে পড়ছে।
- ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান: ৪৩,৫৩৯ কোটি টাকা।
- সরকার ভর্তুকি দিয়েছে: ৩৯,৫৩৪ কোটি টাকা।
অর্থাৎ, ভর্তুকি দিয়েও পুরো ক্ষতি পূরণ করা যাচ্ছে না। এর ফলে সরকারের উপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ তৈরি হচ্ছে।
সাধারণ ভোক্তার জীবনে প্রভাব
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি সরাসরি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে।
- বাসাবাড়ি: বিদ্যুতের বিল বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে অন্য খরচ কমাতে হবে।
- সেচ খাত: কৃষকরা অতিরিক্ত ব্যয়ের মুখে পড়বেন, যা কৃষিপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে।
- বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান: দোকান, অফিস, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদির খরচ বাড়বে, যা ভোক্তাদের উপর চাপাবে।
- শিল্প খাত: উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, ফলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকবে।
- শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান: অতিরিক্ত ব্যয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসা আরও ব্যয়বহুল করে তুলবে।
জাতীয় অর্থনীতি ও শিল্পে প্রভাব
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মানেই শুধু বিদ্যুৎ খরচ বাড়া নয়, বরং পুরো অর্থনীতিতে একধরনের ডমিনো এফেক্ট তৈরি হওয়া।
- কৃষিপণ্য ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি: সেচ খাতে বাড়তি খরচের কারণে বাজারে শাকসবজি, চাল, গমসহ নিত্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে।
- মুদ্রাস্ফীতি ত্বরান্বিত হবে: ইতিমধ্যেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থাকা অবস্থায় বিদ্যুতের নতুন খরচ মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে তুলবে।
- শিল্প ও রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা কমে যাবে: বিশেষ করে গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও ভারী শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
- বেকারত্বের ঝুঁকি: শিল্পখাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মসংস্থান কমাতে বাধ্য হতে পারে।
নীতিনির্ধারণ ও নতুন আইন
আগে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া ছিল গণশুনানি নির্ভর। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) জনগণের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত দিত।
কিন্তু ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আইন সংশোধনের পর থেকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোর ক্ষমতা পেয়েছে। এর ফলে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি দ্রুততর হলেও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ কমে গেছে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বিদ্যুতের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি থেকে মুক্তি পেতে হলে বিকল্প সমাধান খুঁজতে হবে।
- পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি: সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ও বায়োগ্যাসকে গুরুত্ব দিতে হবে।
- ভর্তুকি ব্যবস্থার সংস্কার: প্রকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত।
- বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি ও অপচয় নিয়ন্ত্রণ: উৎপাদন ও সরবরাহের দক্ষতা বাড়ালে ব্যয় কমানো সম্ভব।
- স্মার্ট গ্রিড ও প্রযুক্তি ব্যবহার: আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা উন্নত করা গেলে ক্ষতি কমবে।
- শিল্পোন্নত বিদ্যুৎ নীতি: শিল্প খাতকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে বিশেষ বিদ্যুৎ প্যাকেজ দেওয়া যেতে পারে।
শেষ কথা
বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়তো সরকারের জন্য তাৎক্ষণিক আর্থিক চাপ কমানোর উপায়, কিন্তু এর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাপক। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে কৃষক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি—সবার জীবনেই এই সিদ্ধান্ত নতুন বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
তবে দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ খাতকে টেকসই করতে হলে শুধুমাত্র দাম বাড়ানো যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন উৎপাদন খরচ কমানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ঘটানো এবং ভর্তুকি ব্যবস্থায় সঠিক লক্ষ্যভিত্তিক সংস্কার আনা।